আমি কেরর না অসুর : শম্ভু রক্ষিত



আলোচনা- শিবাশিস দত্ত

কবি শম্ভু রক্ষিত ষাটের দশকের কবি বলে পরিচিত। এ দশকের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কবি মণীন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন  :
"ষাটে'র কবিগোষ্ঠী সত্যিই দলহীনদের একটা দল। তাঁদের চরিত্রের কোনো সামগ্রিক রূপ বা কবিতার কোনো মূল সুর খুঁজতে যাওয়া বিড়ম্বনা।"
এ বিড়ম্বনা কি ইতিবাচক হয়ে উঠেছিল শম্ভু রক্ষিতের মতো কবির জীবনে--না কি এহেন বিড়ম্বনাকে কুর্নিশ জানিয়ে পথ চলেছেন তিনি? অস্পষ্টতার ঘোরে নিজেকে শনাক্ত করার দায় মানেন যিনি, তিনি হাজার রকমের বিড়ম্বনাকে আত্মগত করতে পিছপা নন। ঝোঁক নয়, ঝুঁকির নেশা তাঁর জীবন ও কবিতাকে ব্যতিক্রমী করে তুলতে পারে। সে কারণেই কি লেখেন :
'আমার অস্তিত্বের কেন একটা অজ্ঞাত উদ্দেশ্য আছে --আমি জানি না...
 
..........
আমি ঊষার অস্পষ্ট আলোতে নিজেকে বিশ্লেষণ করি......
 
.........
আমি বাস্তবিক ভয়ংকর।...
এই ভয়ংকরতা সাধনামূলে প্রতিষ্ঠা পেলে কবিতা অস্থিমজ্জায় বদলে যায়। শম্ভু রক্ষিতের কবিসত্তায় এ ধরনের ঘটনা ঘটে যাওয়া বিচিত্র নয়। 
এ বইতে দুটি ছোট কাব্যনাটক আছে। প্রথমটির নাম : 'নিরত্যয়'। এ কাব্যনাটকে ব্যবহৃত কয়েকটি শব্দযুগল হল -- 'বৃক্ষহীন জগৎ',
' নক্ষত্রপুঞ্জের চিৎকার', 'তন্দ্রাচ্ছন্ন ত্রিভুজ।' পাখিদের ঠোঁট-পরা ভ্রূণতত্ত্ববিদ কিংবা অ্যাক্রেলিক রঙে আঁকা নারীর দেখা মিলবে এ নাটকে। এ কাব্যনাটকে ক্রুদ্ধ দেবদূত জল দিয়ে তারাগুলোর নাভি কেটে দেয়, সূর্য ধীরভাবে মাটিতে নেমে আসে। বলবার কথা হল, আলোচ্য কবির কাব্যকবিতায় অধিদৈবতকে (spirit) অতিসক্রিয় হতে দেখি। অধিদৈবত কী?  এ হল সৃষ্টিশীল শিল্পীসত্তা। অমিয়ভূষণ মজুমদার বিষয়টির মেধাবী ব্যাখ্যা শুনিয়েছেন :
...বিশ্ব অচেতন(collective unconscious --Jung) সংপৃক্ত সেই যে ভাষাহীন মানুষে, প্রস্তরখণ্ডে, বৃক্ষলতায়, সূর্যচন্দ্রে, বিভিন্ন ঋতুতে, নদীতে পর্বতে পৃথক পৃথক রূপে বর্তমান ছিল। একদিকে সে ভাষাহীন, আদিম, অচেতনপ্রায়, আত্মারও পূর্ববর্তী। অন্যদিকে তার বাইরে যা কিছু দৃশ্যমান, শ্রাব্যমান, চলমান, ঘটমান, তা তার অন্তর উপলব্ধির বহিঃপ্রক্ষেপণ মাত্র।...
 
এই হল অধিদৈবতের আন্তর উপলব্ধি।
  শম্ভু রক্ষিত এ উপলব্ধির জগৎকে যথেষ্ট দক্ষতায় ব্যবহার করেছেন।
এ বইয়ের শুরুতে কবি জানিয়েছেন :
'কবিতা আমলাতন্ত্র, দীর্ঘসূত্রতা, প্রপার চ্যানেল ও লালফিতার নাগপাশ থেকে মুক্ত, সম্পূর্ণ মুক্ত।'...
অর্থাৎ কিনা, যাকে আমরা বলি পণ্যসমাজ, যেখানে রাজনীতি, আমলাশাহী বা পুঁজিবাদী  কালচারের নষ্টামি আছে, বাজারসর্বস্ব ধান্ধা তথা লেনদেনের তেমন কোনো সম্পুটে কবিতাকে বন্দি  করা যাবে না। কবি যেন তাঁর নিজস্ব স্বপ্নের  ভুবন গড়ে নিয়ে সে চৌহদ্দিতেই কবিতাকে নির্মাণ এবং লালন  করেন, এ কাজে কোনো বস্তুগত অভিপ্রায় জাগে না। নয়তো বইয়ের প্রথম কবিতার প্রথম দুটি লাইনে কেনই বা লিখবেন --
'আমি গত ১০ বছর ধরে পৃথিবী বহির্ভূত এক সভ্যতার /প্রতিনিধিদের সঙ্গে আছি...
কবি শম্ভু রক্ষিত বিষ্ণু দে কিংবা জয়দেব বসুদের মতো বামপন্থা, ইজম মানেন তা নয়, তবে তিনি বিপ্লবপন্থী। তাঁর কবিতায় পড়ি : ' বিপ্লব থেকে মানুষের মনকে ওরা দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবার পক্ষে।' রাষ্ট্রীয় নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে  সোচ্চার হয়েই তিনি কবিতাকে উৎপাদন করেন। গোঁড়া তাত্ত্বিক প্রত্যয়কে প্রশ্রয় দেন নাকাব্যিক কোনো নির্দিষ্ট ধারার অনুবর্তীও তিনি নন। ভোগবাদী রাজনীতি এবং তার দর্শনকে শ্লেষবিদ্ধ হতে দেখি
  তাঁর কবিতায়:
'আমাদের স্বপ্ন হল প্রত্যেক গ্যারেজে একটি করে গাড়ি / এবং প্রত্যেক টেবিলে পালিশ করা ময়দার রুটি, /দুটি চিকেন
আপনি, আমাদের এখানে থেকে যেতে সহায়তা করুন' (স্বাধীনতা ৫০)
অপর একটি কবিতায় বিদ্রূপ শাণিত হয়েছে বঙ্গসমাজের প্রতি :
'বঙ্গদেশ টুপিপ্রদর্শক দেশ। এই দেশে সর্বাধিক বিক্রীত বস্তু টুপি।... সেই দেশের অধমাধম আবহমানকাল ধরেই টুপি পরে আসছে। তাদের টুপি পরার ইতিহাস ১০০০০ বছরের। তারা টুপিকে দেবতার দূত, অপদেবতা ও মানুষের মাঝে হিসেবে ধরে...' (বঙ্গদেশে টুপি)
   পাঠকের কথা ভেবে তিনি  কবিতা লেখেন না। অপ্রচলিত কিংবা অজ্ঞাত শব্দ জুড়ে জুড়ে তিনি অনুভবের যে বিস্ময়ঘন পরিসর গড়ে তোলেন, চেনা আবেগ কিংবা চালু মেধামন সম্বল করে কবিতার সে ম্যাজিককে ছোঁয়া যায় না। বিশেষত, 'কবিতার গতিপথ, ধারা সম্পর্কে এখনও অনেক কিছুই অজ্ঞাত' (লিখছেন কবি) যখনবৃক্ষচ্যুত ফলের মতো কবিতাকে পেড়ে আনা সম্ভব নয়। কবির একটি
কবিতার নাম :ৎসং-এর পুনর্জন্ম। প্রথম লাইন :
'ৎসংয়ের আদিটুপিদল ধর্মরাজিকায় এসে সমবেত হতে পারেনি... '
কিছু পরেই লিখছেন :
'আমার বুকের ভেতর বৃদ্ধাযুবতীজননীজায়া সহচরীরা কিরকম যেন আকুলিবিকুলি করছে/আমি জানি না পৌরাণিক ও অপৌরাণিক এই করুণের সৃষ্টিকর্তা কে!'
প্রত্নস্মৃতিগুলোকে আধুনিক চেতনায় প্রবিষ্ট করে এক ধরনের আদিরূপাত্মক ভাবের উপাদান গড়ে তোলেন কবি। শম্ভু রক্ষিতের কবিতায় নির্জ্ঞান মনের এবং একই সঙ্গে শব্দের ব্যতিক্রমী ব্যবহার করণকৌশলের ভিন্ন মাত্রা গড়ে তোলে। আরও কয়েকটি কবিতার লাইন :
১.আমি দেহ না আত্মা বদ্ধ না মুক্ত আমি কেরর না অসুর
২.মৃত কুকুরদের তোয়াজ টোয়াজ করে রেখেছি কাচের ঘরে/আঃ তাদের চরিত্র খারাপ হয়ে যায়। (চরিত্র এই রকম)
৩.তানাবাতা, তানাবাতা, আমি নিজেই আমার রুগ্ন ধমনী কেটে /তার জায়গায় প্লাসটিকের ধমনী বসাচ্ছি
৪.এক ক্ষুদে ভ্রূণ ধর্মীয় টেবিলে বসে কাঁদে। এক অশুভ ঝালর মুমূর্ষু ঘর হয়ে ফোঁসে আর গর্জায়। আর ঘরের নিচে অ্যালুমিনিয়াম তুষার জমে থাকে।...
সংবেদন গড়ার পাশাপাশি যেন ধাঁধা তৈরির নেশায় মেতে ওঠে কবির শব্দজগৎ। বাস্তবতার পরতে পরতে জমে থাকে পরাবাস্তবতার অব্যর্থ  উপাদান। আর এ সবের মাঝে খুঁজে নেওয়া যায় কবির আত্মজৈবনিক সত্তাকে --'আমি এক আবেগে এক নতুন মানুষ হয়ে উঠেছি/এক গভীর পরিবর্তন এসেছে আমার মধ্যে... '
বস্তুগত স্পৃহার প্রতি দৃঢ় অনাস্থাকে জীবনধর্ম বানিয়ে ফেলেন যিনি , তিনি তো স্টোয়িকদের দলে। শম্ভু রক্ষিতের জীবনাচরণে তেমন কৃচ্ছসাধনার ছাপ আছে। তিনি  তাঁর জীবনকে কবিতায় পৌঁছে দেন, কবিতাও জীবনধর্মী হয়ে ওঠে। প্রশ্ন হল, কবির  প্রাচীনকালের ম্যাজিক বুঝে ফেলার কারণ কীকিংবা তিনি প্রেততত্ত্বে মনোনিবেশের কল্পনাকে কবিতায় স্থাপন করেন কেনতাঁর বর্তমানে টিকে থাকার কৌশলই বা কী? ভবিষ্যৎকে কোন চোখে দেখেন তিনিকোনো
  দুর্জ্ঞেয় অতীতকে আঁকড়ে থাকার ছল কি করেন কবি? এ অনুমানও ভ্রমাত্মক কারণ, তিনিই আবার লেখেন --'...আমাদের মধ্যে যারা এখনও জন্মায়নি লাল কালো ধূসর কোমল কমলারঙের /মাটি দিয়ে তাদের অবয়ব তৈরি করেছি...' (জ্ঞাতিগোষ্ঠীবোধ)
আসলে কবিতার শব্দভাষাকে তিনি এক ধরনের ঐন্দ্রজালিক নির্মিতিতে পৌঁছে দেন যেখানে কবিতা উদ্ভট শরীরেই হয়ে ওঠে সংবেদনশীল। তাতে কীকবিতা তো আর লজিক কিংবা জ্ঞানতত্ত্বের আওতাভুক্ত নয়। তাছাড়া কবির অভিলাষ হল --
'আমি চাই লোকে আমাকে বিকট অগ্রাহ্য করুক।'

আমি কেরর না অসুর : শম্ভু রক্ষিত /মহাপৃথিবী /তিরিশ টাকা



2 comments:

  1. দেবজানী দে ৷ অত্যন্ত সুনিপুন,তীক্ষ্ণ বিশ্লেষ্ণাত্মক অথচ প্রাঞ্জল আলোচনা।

    ReplyDelete
  2. সমৃদ্ধ আলোচনা। ভালো লাগল।

    ReplyDelete