।। বাক্‌ ১২৪ ।। তপোভাগ ।। সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় ।।





তপোভাগ   :   পঞ্চম পর্ব

রাত্রিটি বিস্ময়! পূর্ণচন্দ্রের রাত্রি, চরাচর ভেসে থাকবার কথা কিন্তু ঋতু বর্ষণের, মেঘ ছেয়ে রয়েছে আকাশে। যদিও সে মেঘ ঘন নয়। চন্দ্র দৃশ্যমান নয় অথচ তাঁর আলোকের আভাসে প্রকৃতি মায়াময়। এ যেন এক অন্য পৃথিবী। চন্দ্রমার আলোও যেন উগ্র, তাকে ঢেকে রেখেছে মেঘের এক পরত, তাতে সেই জ্যোৎস্না আরো মৃদু হয়েছে। চন্দ্রালোকেরও কিরণ হয়, তাতেও ছায়া পড়ে, কিন্তু এখন তা নেই। এখন, আভা। এ পৃথিবী যেন বা স্বপ্নের, এমন ভ্রম মাঝে মাঝে ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে রাত্রিচর কোন কোন পাখির ডাকে, তাদের ডানা ঝাপটানোর শব্দে, এবং লোকালয়ের কুকুরগুলির ডাকে। তাও দূরাগত, ক্ষীণ। আবছা অবয়বে পৃথিবী। 
যে কোন রাত্রি ঘুমিয়ে অতিবাহিত করার জন্য নয়। শয্যা ছেড়ে উঠে এসেছেন জরাসন্ধ। শয্যাপার্শ্বে তাঁর নারী সুপ্ত, তাঁকে জাগাননি তিনি। কিছু কিছু মুহূর্ত থাকে, যা শুধু নিজের। যা একান্তভাবে নিজস্ব।
কন্যাসন্তান দুইটি সর্বত্র ছুটে বেড়ায় সারাদিন। যে পিতার কন্যা তারা, প্রানশক্তি তো অত্যধিক হবেই! উপযুক্ত পুরুষের হাতে দিতে হবে তাদের, জরাসন্ধের জামাতা, যেন জরাসন্ধতুল্য বীর হয়। তিনি স্থির করে রেখেছেন, মল্লযুদ্ধের পরীক্ষা নেবেন তিনি। তাতে যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট হবেন, তেমন বীরের হাতে দেবেন কন্যাদের। তাঁকে মল্লযুদ্ধে ভূমিশায়ী করবে, এমন কেউ অবশ্য নেই, জন্মাবেওনা। তিনি সন্তুষ্ট হলেই যথেষ্ট মনে করবেন। তেমন অন্ততঃ একজন পাওয়া গেলে একজনের হাতেই দুই কন্যাকে দেওয়া যায়। জামাতাকে অবশ্যই জরাসন্ধের যোগ্য জামাতা হয়ে উঠতে হবে। 
কোল্লরা শরসন্ধানে পটু। এবং তারা অরণ্যকে, এই মৃত্তিকাকে, তার উদ্ভিদ ও প্রাণীকে চেনে গভীরভাবে। কিন্তু তারা ধূর্ত নয়। আনন্দময় জীবন তাদের, জল মাটি অরণ্য পশু নিয়ে।
  শবরেরা অতি ধূর্ত। হিংস্রও। কোলরা রয়ে গেছে অরণ্যের গভীরে গভীরে, শবরেরা জনপদের আশেপাশেই বাস করে। এই দুই প্রকার মানবগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য অন্য রাজপুরুষেরা জানতে বাধ্য হচ্ছে এখন। জরাসন্ধ তাদের চেনেন। অতি স্পষ্টভাবে চেনেন।  কোল্লদের কাছে তিনি শরসন্ধান শিখেছেন। ওদের শর ধরবার পদ্ধতি একটু অন্যরকম, তাতে লক্ষ্য আরো নিখুঁত হয়, কীভাবে লক্ষ্যটিতে দৃষ্টি সন্নিবদ্ধ করতে হবে, এও তাদের কাছেই শেখা। ভল্ল কুঠার সহ অন্য অস্ত্রও ব্যবহার করতে শিখেছেন তিনি, ক্ষত্রিয়কে সমস্ত অস্ত্রের কৌশলই জেনে রাখতে হয়। কিন্তু ওই সমস্ত লঘুভার অস্ত্রে তাঁর তৃপ্তি হয় না। অস্ত্রের মধ্যে তাঁর একমাত্র পছন্দ, গদা। আহা, সুবিশাল, ভারী, ঘাতসহ। এ অস্ত্র হাতে নিলে তবে তার মনে হয় কিছু হাতে আছে বলে। অন্য অস্ত্রগুলি, যেন বা শরীরের কেশরাশি, অঙ্গে রয়েছে বলে অনূভুতই হয় না। তাঁর গদাটি বৃহদাকার, সেটির একটি আঘাত খেলে কোন মনুষ্যকে এই পৃথিবীতে লম্বভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না, আনুভূমিকভাবে শায়িত হয়ে পড়তে হয়।
যদিও, গদার থেকেও প্রিয় অস্ত্র তাঁর, বাহু। দুইটি বাহু তাঁর গদাসম, মল্লযুদ্ধে কাউকে একবার ধরলে পঞ্জরাস্থি ভগ্ন না করে ছাড়েন না, উন্মত্ত বন্য মহিষকে দুইহাতে থামিয়ে দিতে পারেন তিনি, পূর্ণবয়স্ক বৃষকে তুলে ফেলতে পারেন মাটি থেকে কোলে। ইদানীং মল্লযুদ্ধের অভ্যাস তাঁকে একা একাই করতে হয়, অন্য যার সঙ্গেই অভ্যাস করতে যান, তার হস্তপদ কিছু না কিছু ভাঙেই। 
আর কোন মনুষ্য নেই, পৃথিবীতে আর কোন মনুষ্য নেই বিজয়যোগ্য, জরাসন্ধ মাঝে মাঝে ভাবেন, খালি হাতে এবার ব্যাঘ্র বা অনুরূপ আরণ্য পশুর শক্তিপরীক্ষা করবেন। পশুবল প্রবল, তিনি মনুষ্যের উদ্ভাবিত কৌশল ও বাহুবল দিয়ে এবার অমিত বলশালী পশুশক্তিকে জয় করতে চান।
  
মস্তিষ্কে মদ চড়ে থাকে। ঘুমন্ত থাকলেও তা নিবৃত্ত হয়না, সংজ্ঞামাত্রই আবার তা শীর্ষে স্থান নেয়। কেউই আর অজেয় নয়, কোন বাধাই আর অনতিক্রম্য নয়, কোন বীরই সমীহযোগ্য নয়, কোন সমস্যাই বুকে কাঁপন ধরায়না। এই মত্ততা, এই উত্তুঙ্গতা মস্তিষ্কে মদ হয়ে ছেয়ে থাকে।
 
ডিম্বক ও হংস। আহা, তার দুই সাথী, দুই শিষ্য, দুই সন্তান তার। যেমন বীর, তেমন অনুবর্তী। জরাসন্ধের আজ্ঞায় তারা বাঘের সামনে চলে যেতে পারে নিরস্ত্রে, অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে দেবে অবলীলায়। তাঁর সেনাপতি তারা, তিনি একবার ভেবেছিলেন এই দুই পুরুষের হাতে তাঁর কন্যাদের দেবেন। কিন্তু পরে দ্বিধা হয়েছে। দেবেন? জামাতা হবে তারা? হলে অবশ্য ভালোই হয়, মেয়েরা সুখে থাকবে আজীবন, তারা বীরও বটে। কিন্তু, তারা বড়োই অনুগত। জামাতা একটু বেয়াড়া হবে, শ্বশুরকে একটু অগ্রাহ্য করবে, তাঁর প্রতি ঈষৎ উন্নাসিক অবজ্ঞা পোষণ করবে, তবে তো জামাতাকে মানায়। নারীর প্রথম পুরুষ তার পিতা। নারীর প্রকৃত পুরুষ, সেই নারীর প্রথম পুরুষকে পছন্দ করবেনা, তাঁকে বেচারা মনে করবে, এটাই মানায়। জামাতার আচরণে শ্বশুরের প্রতি অবজ্ঞার সঙ্গে খানিক দয়া মেশানো থাকবে। 'তোমার স্নেহপুত্তলী এখন আমার দাসী, ভেবোনা, সে এতেই বেশি সুখী' এমন এক ঔদ্ধত্য তার চোখেমুখে প্রকাশ পাবে, এটাই স্বাভাবিক, এইই মানায়। ডিম্বক ও হংস তাঁর কন্যাদের বিয়ে করলে তা হবে না। তারা হয়তো স্ত্রীর সাথে মিলিত হবার জন্যও তাঁর অনুমতি প্রার্থনা করতে আসবে। অথবা, শয্যায় যাবার আগে হয়তো তারা স্ত্রীর পদবন্দনা করে নিতে চাইবে। তারা জরাসন্ধের কন্যা কি না!
হেসে ফেললেন জরাসন্ধ। রাত্রি মধ্যযাম পেরিয়েছে অনেক আগে। প্রহরে প্রহরে শৃগাল ডেকে যায়। ঈষৎ উচ্চভূমির ওপর এই গৃহ, বেশ খানিকটা পৃথিবীর অবয়ব এখান থেকে অনুমান করা যায়। দেখা যাক, মেয়েরা বড়ো হোক, সময় এখনো অনেক বাকি। সুদূর গান্ধার থেকে পূর্বে অঙ্গদেশ, বিস্তীর্ণ এই আর্যাবর্তে বহু যোগ্য রাজবংশ, তাঁর কন্যাদের যোগ্য পুরুষ অবশ্যই খুঁজে পাওয়া যাবে।
আর্যাবর্তের কিছু কিছু প্রথা তাঁর হাস্য উদ্রেক করে। যেমন রাজসূয় যজ্ঞ, যেমন অশ্বমেধ যজ্ঞ। অশ্বমেধ যজ্ঞে, ঘোড়াটি ছাড়া হয়, সে আপন মনে দৌড়োয়, পশ্চাতে রাজসৈন্য। যে ঘোড়াটি ধরার দুঃসাহস করে, তাকে যুদ্ধদান করতে হয়। বেশ, এতদূর ঠিক আছে।  তারপর, যুদ্ধে সে মারা গেল তো গেল, নইলে শুধু হেরে গেলে তাকে আবার মুক্তি দিয়ে, তার কাছ থেকে কিছু উপঢৌকন নিয়ে তাকে তার রাজ্যেরই রাজধানীতে বসিয়ে আবার অশ্ব ছোটানো হয়, এবার অন্যদিকে। রাজসূয় যজ্ঞে আবার, বহুসংখ্যক মুনিঋষিব্রাহ্মণ এবং ভূপতিকে নিমন্ত্রণ করে এনে অনেক দিন ধরে যজ্ঞ এবং দান, যজ্ঞ এবং দান করা হয়। তারপর সেই নৃপতিরা সন্তুষ্ট হয়ে আপন রাজ্যে ফিরে যান।  ঋষিব্রাহ্মণরা রাজাশ্রয়ে বিস্তর পানভোজন করেন, তত্ত্বালোচনা করেন এবং সামর্থ্যানুসারে আশীর্বাদ ও অভিশাপ দিয়ে আবার বেরিয়ে পড়েন। এসব যজ্ঞ করে কি হয়? যুদ্ধ নেই, রোমাঞ্চ নেই, বিপদের সন্মুখীন হবার তীব্রতম সুখ নেই, অনিশ্চয়তার আভাস নেই কোনও, এই চর্যায় ক্ষত্রিয় সুখ পায়?
সবচেয়ে বড়ো দুটি কাঁটা হলো যাদবকূল এবং ভরতবংশ। গুপ্তচর সর্বত্রই প্রেরণ করা আছে, সময়ে সময়ে তারা সংবাদ জানিয়ে দেয়, জরাসন্ধ দুই চোখে এই দুই বংশকে লক্ষ্যে রেখেছেন। যাদবরা তবু বহু গোষ্ঠীতে বিভক্ত, তাদের মধ্যে মিলও যতো, বিভেদ তৈরি হওয়াও ততোটাই সহজ। ভোজবংশের একটি শাখার একটি দামাল কিশোরের সংবাদ প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে, তাঁর কীর্তিকলাপ জরাসন্ধকে আকৃষ্ট করেছে, তাঁর সংবাদ জানবার জন্য একটি চর বিশেষভাবে নিযুক্ত রেখেছেন তিনি। সেই দামাল ছেলেটির নাম, কংস। 
ভরতবংশ সবথেকে শক্ত কাঁটা, একে উচ্ছিন্ন করতে তাঁকে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে, জরাসন্ধ জানেন। বংশ অতি প্রাচীন, অতি সমৃদ্ধ ভূমি সেই রাজ্যের তাই প্রজারা সুখী ও সম্পন্ন, ইতিহাস এই বংশের এমনই যে স্তম্ভিত হতে হয়, সেই বংশের কাহিনীমালা শুনে বালকের ন্যায় রোমাঞ্চিত হতে হয়! তবে এই বংশেও বংশরক্ষার দায়ে ইদানীং যেন গ্রহণ লেগেছে! শান্তনুর নারীগৃধ্নুতা এর জন্য দায়ী। এখন সেখানে সঠিকভাবে রাজপদে কেউ নেই, যুবরাজ কেউ নেই, রাজপিতা কেউ নেই, যিনি আছেন, তিনি একাধারে রাজপিতা যুবরাজ সেনাপতি সবই। তিনি এই বংশটির মস্তকে ছত্র হয়ে রয়েছেন, যাবদীয় আঁচ, যাবদীয় ঝাপটা নিজে সামলে দুই ভ্রাতুষ্পুত্রকে বড়ো করছেন। ভীষ্ম। এক বীর, এক দীর্ঘাকার মানুষ, এক অনতিক্রম্য পর্বত। প্রতিজ্ঞারক্ষার জন্য পরশুরামের মতো উগ্র অগ্নির মুখোমুখি হতে যে মানুষ সুখ পায়, সে যে সে বীর নয়! এমন বীরের মুখোমুখি হতেই সুখ, আহা!
হবে, হবে, কোনোদিন তাঁর সঙ্গেও দেখা হবে। আহা, সেই তাঁর স্বপ্ন। ভীষ্মের সঙ্গে সন্মুখযুদ্ধ।
যদিও, ভীষ্মের যার সাথে যুদ্ধ হয়েছিল, তিনি সপ্তদশ রাম, বংশধারার সাথে যিনি পরশু ধারণ করেন। ইনিও ভার্গব, কিন্তু ইনি তিনি নন। বংশধারায় পূর্বপুরুষের তেজ স্তিমিত হয়, বিলুপ্ত হয়, আবার কোন একটি প্রজন্মে আবার ফিরে আসে। আদি পরশুরামের পর চতুর্থ রামে ফিরে এসেছিলো সেই তেজ, কয়েকগুণ শক্তিবৃদ্ধি করে। ইনিই সেই ক্ষত্রিয়নিধনের জন্য বিখ্যাত রাম, যিনি একুশজন ক্ষত্রিয় নৃপতিকে হত্যা করেছিলেন। তারও পরে আরো দুয়েকবার রামের নাম উজ্জ্বল হয়েছিলো, এখন এই বর্তমান রাম প্রধানতঃ ব্রাহ্মণ, তাঁরও চরিত্রে উগ্রতা আছে বটে, কিন্তু অপরাপর ন্রাহ্মণের মতোই হত্যাগৃধ্নুতা নেই। আর এই হত্যাগৃধ্নুতা না থাকলে যুদ্ধ হয় না, ক্রীড়া হয়। যদি আদি ভার্গব পরশুরামের মুখোমুখি হতে হতে শান্তনবকে, বা চতুর্থ রাম, তাহলে কি অজেয় থাকতে পারতেন ভীষ্ম? জরাসন্ধ জানেন, পারতেন না। কুঠারে ছিন্ন হতো তার মস্তক।


No comments:

Post a Comment