পর্ণমোচী জীবন, পর্নোমোচী সাহিত্য, এবং হেনরি মিলার
অনুপম মুখোপাধ্যায়
নারী এবং
পুরুষের ভেদটা সম্ভবত ততটা বায়োলজিকাল নয়, শারীরিক নয়, যতটা সামাজিক। কে ইন্দ্র আর
কে শচী, কে মদন আর কে রতি, এই সিদ্ধান্ত শরীর ততটা নেয় না, যতটা নেন সমাজের
ধারক-বাহকরা। যে শিল্পী এবং সাহিত্যিক এই ভেদটাকে
অস্বীকার করতে চান, সবার আগে তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আসে, সেটা
অশ্লীলতার। এমনকি মহাকবিরাও রেহাই পান না, তাঁদেরও একটা সময় সমাজের টেবিলে ফেলে
অন্ধভাবে ইস্ত্রি করে নেওয়া হয়। অযোধ্যার রাজা রামচন্দ্রকে নপুংসক প্রমাণ করার
একটা চেষ্টা কিছু পণ্ডিতমন্য মানুষের মধ্যে দ্যাখা যায়, কিন্তু আদি বাল্মিকী
রামায়ণ পাঠ করলে বোঝা যায় রামচন্দ্র তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে একটি অত্যন্ত সুস্থ সমর্থ ও
প্রকাশ্য কামজীবন যাপন করছিলেন, পূর্ণ যুবতী সীতার পক্ষে সম্ভবই ছিল না এমন একটি
স্বাস্থ্যবান রূপবান বরকে ছেড়ে রাজপ্রাসাদে থাকা, তাই তিনিও বনে গেলেন, কিন্তু বাদ
সাধলেন রাবণ। সীতাকে হারিয়ে রামের যে কাতর বিলাপ, তা এক যৌনসঙ্গী হারিয়ে ফেলা
প্রাণীর সঙ্গে মিলে যায়, অবিশ্যি কৃত্তিবাস ওঝা বা তুলসিদাসের কানেও তা ধরা পড়েনি। হৃৎপিণ্ড থেকে যে আশ্চর্য হরমোন ক্ষরিত হয়, বাল্মিকী তার স্বভাব জানতেন।
তাঁর রাম আদৌ নপুংসক ছিলেন না, বরং সদ্য-বিবাহিতা পত্নীটিকে ছেড়ে দাদা-বৌদির সঙ্গে
বনে শেল্টার নেওয়া লক্ষ্মণ সম্পর্কেই আমার তেমন সন্দেহ জাগে। কামবাসনার দিক থেকে রাম আর রাবণের
পার্থক্য শুধু একটি অপহরণের। আর কিছু নয়। মহাভারতেও
কৃষ্ণ-অর্জুন-সত্যভামা-দ্রৌপদীর যৌথ যৌনাচার দেখে ফেলেছিলেন
দূত সঞ্জয়। কর্ণ-ভ্রুশালী-ভানুমতী-দুর্যোধনের কামজীবনেও হয়ত ছিল না কোনো আড়াল।
তাঁর যৌনাচারের সময় ঢুকে পড়ায় কৃষ্ণ কুষ্ঠরোগের অভিশাপ দিয়েছিলেন পুত্র শাম্বকে।
অবিশ্যি কীর্তনের আসরে সেই ঘটনার উল্লেখ মেলে না। এই আমাদের দেশ। এই আমাদের দেবতা।
এই আমাদের প্রাচীনতম সাহিত্য, অথবা ইতিহাস।
কিন্তু এই দেশ তো হেনরি মিলারের নয়। আমেরিকান লেখক হেনরি মিলারের স্নানঘর
নিয়ে একটা আলাদা ডকুমেন্টারি রয়েছে ইউ টিউবে। আমাদের দেশে সেন্সর বোর্ড সেটাকে মরে
গেলেও ছাড়পত্র দেবে না অবিশ্যি। সেখানে
দেখলাম হেনরি মিলার সুন্দর একটি ঘুম থেকে উঠলেন, তাঁর বিখ্যাত স্নানঘরে ঢুকলেন,
সেখানে দেওয়ালজোড়া মেয়েদের ছড়াছড়ি, পোশাকের সম্পূর্ণ বাইরে অথবা ঈষৎ ভিতরে তাঁরা
বসে আছেন, দাঁড়িয়ে আছেন, প্রাণ থেকে হাসছেন, সতেজ উন্মুক্ত উন্মুখ সব অঙ্গ, মাংস
থেকে যেন পিছলে নামছে ক্লোরোফিল, আর বিভিন্ন দেশের লেখক, দার্শনিক, পারফর্মার ও সন্ন্যাসীদের
ছবিগুলোর পাশাপাশি সেই মেয়েরা অনাবিল অলজ্জভাবে আছেন, এমনকি মৈথুনের তুঙ্গ
মুহূর্তেও তাঁদের ছবি তোলার আগ্রহ, আর সেই সঙ্গে চলল হেনরি মিলারের আশ্চর্য অকপট
কথা বলা, ওভাবে কথা একমাত্র তিনিই বলতে পারেন, সেই কথার ফাঁকেই এক জ্বলজ্যান্ত
রমণী বেরিয়ে এলেন ঈষৎ উল্লসিতভাবে, তিনি স্নান করছিলেন, হেনরি মিলার সাগ্রহ মমতায়
মুছিয়ে দিলেন রমণীর পিঠ ও শরীরের সিক্ত পশ্চাদভাগ, তারপর আবার চলল তাঁর আশ্চর্য
কথা বলা, যা শেষ হল রাজপথে নেমে হারিয়ে ফেলা শৈশবের ব্যথায়, ক্যান্সারাক্রান্ত
শহরটির সাড়হীনতায়। এই হল জীবন, এই হল
ভণ্ডামিহীন পাতা ঝরানো যাপন, স্নানঘরের দেওয়ালে তার একটা ধারাবিবরণী ধরা আছে।
কিন্তু সে তো আমাদের বিদেশ, সে আমাদের কালাপানি, আমাদের
অচ্ছুৎ সংস্কৃতি। নকল রঙের চিরসবুজ লেখক তাই হেনরি মিলারকে হতে হয় না, তিনি
পাতাগুলো ঝরিয়ে দ্যান, যেন সেগুলো রেচন পদার্থে ভরে গিয়েছিল।
হেনরি মিলার সেই লেখক, যিনি জীবনে একটিও অক্ষর যদি না লিখতেন, যদি একটিও বই
তাঁর প্রকাশিত না হত, পৃথিবীতে কেউ যদি তাঁর নাম না জানত, তবুও তিনি লেখকই থাকতেন।
এই জাতের লেখকরা আলতামিরার সেই শিল্পীদের মতো, যারা বাইসন এঁকেছিল, যারা বন্য
জন্তুর দৌড় বোঝানোর জন্য এঁকে দিত চারের বদলে আটটি বা বারোটি ছুটন্ত পা। লেখা এই
লেখকদের নিয়তি। লেখা, এই লেখকদের জীবনে কোনো শূন্যস্থান পূরণ নয়, বরং স্বয়ং জীবন।
এই লেখকরা নিজেরাই লেখা। মিথ্যা আর সত্যের অভেদে হেনরি মিলারের মতো লেখকরা পৌছেছেন,
লেখা এবং না-লেখার ভেদটাকে মুছে ফেলেই, সেটার জন্য যে সংগ্রাম তাঁরা করেছেন তারও
নাম জীবন, হয়ত আরেক নাম যাপন। স্বয়ং লেখা হয়ে ওঠা এই মানুষটিকে সহ্য করা কিন্তু
খুব সোজা ব্যাপার নয়। এর একটা কারণ, মিলারের
লেখাগুলো আসলে না-লেখা। যা তিনি বানিয়েছেন, তাও আগে থেকেই হয়ে ছিল, হয়ে আছে, হয়ে
থাকবে। তাঁর লেখা আসলে একটি খননকার্য। তাঁর লেখা আসলে এক সমুদ্রযাত্রা, যেখানে
নৌকো স্বয়ং তিনিই, মাঝিও তিনি, এবং সমুদ্রটাও কি তিনিই নন, এবং তার তলার প্রতিটি
হাঙর, প্রতিটি সার্ডিন, অক্টোপাস, প্রতিটি বিপুল তিমিমাছও কি তিনিই নন? আবার তিনিই
তো তাঁর হতকুচ্ছিত সময়টার দেবদূত, যিনি আগুনের ডানা নিয়ে নেমেছেন দাহ্য আবর্জনার
স্তুপে।
আর, মাংসের খনন, যে খনিপথ আত্মায় পৌঁছয়? মাংসের মধ্যে যে অপরূপ কার্বন আছে,
আমাদের সংস্কৃতি আজ তাকে শুধুমাত্র কালো রঙেই দ্যাখে। আজ যখন সংবাদমাধ্যমের
পাতায়-পাতায় এবং টেলিভিশন স্ক্রিনে উদ্ভাসিত হয়ে আছে জাপানি তেল আর রকেট
ক্যাপসুলের বিজ্ঞাপন, যখন ‘বোল্ড রিলেশন’-এর নামে হাতছানি দিচ্ছেন দেহপসারীরা, তখন
বাঙালি তার যৌনাঙ্গ নিয়ে অ্যাত ক্যান্সারে ভোগে কেন? জনসমক্ষে মুর্গির ঠ্যাঙ
চিবোতে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু নিজের যৌনজীবন নিয়ে একটি শব্দও তার দাঁতের ফাঁক
থেকে ছিটকে আসা চলবে না। নিরপরাধ পশুর মাংস আর শাকসবজিতে ভরা পাকস্থলী নয়, মলে ভরা
বৃহদন্ত্র নয়, মূত্রে ভরা কিডনি নয়, মদ খেয়ে ফুলে ওঠা লিভার নয়, নিষ্ঠুর হৃৎপিণ্ড
বা ধূর্ত মস্তিষ্কও নয়, শুধু দুই পায়ের ফাঁকে একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত পুলকপিপাসু
অঙ্গকে নিয়েই তার সমস্যা। একটা প্রেমপত্র লিখতে হলেও তার ভিক্টোরিয়ান শুচিবাই থেকে
সে বেরোতে পারে না। স্নানঘরেও নগ্ন হয় না, এই তার ভান। কিন্তু প্রকৃতিতে যে কোনো
শুচিবায়ুই বিকৃতির আরেক নাম। অথবা, এক উলঙ্গ আচরণ, যেন পোশাক পরা হচ্ছে ভদ্রতার
কারনে, যেটাকে বাঙালির সাহিত্যিক ও সাহিত্যিক মাফিয়ারা যৌনমুক্তির নাম দিচ্ছেন।
সাময়িকপত্রগুলো সফট পর্নের আখড়া হয়ে উঠছে। বাঙালি বিকৃতির চরম সীমায় পৌছেছে আজ।
হেনরি মিলারের কোনো উপন্যাস সম্ভবত সে আজ পারিবারিক গ্রন্থাগারের অন্তর্ভুক্ত
করতেই পারবে না। হেনরি মিলারের অকপট কোনো মলাট আজ তার বুকশেলফে সাজানোর নয়। কী করে
সাজাবে সে তাঁকে, তিনি তাঁর লেখায় যে অনায়াসে একজন বুদ্ধিমতী বিদুষী রূপসীকে ‘cunt’ নাম দিতে পারেন, আমাদের এই দেশে সেটা অপরাধ, অবশ্যই, কিন্তু আমরা তো
মহাদেবকেও একটি লিঙ্গ মনে করি, এবং পূজা করি! ছিন্নমস্তার পায়ের তলায় শুয়ে থাকেন
মৈথুনরত মদন আর রতি, যাতে বিকৃত কামের দলন হয়, শুদ্ধ কামের উত্তরণ হয়, পর্নোমোচন
হয়। পরম সাধক মহাকালীকে ‘মাগী’ সম্বোধন করতেন। আসলে, এই মুহূর্তে, আমাদের
সাহিত্য-সংস্কৃতিতে হেনরি মিলারের মতো একজন বেপরোয়া পর্নোমোচী লেখকের খুব প্রয়োজন,
যিনি বিষে বিষক্ষয় ঘটাবেন, যিনি নীলকন্ঠ। তার আগে হেনরি মিলারকে নিয়ে ব্যাপক চর্চা
প্রয়োজন, নাহলে সেই পর্নোমোচীর আগমন আমাদের জনসাধারণ টের পাবে না, তাঁকে ভুল বুঝে
শূলবিদ্ধ করবে।
মানুষের দেবতা এবং রাক্ষস হয়ে ওঠার মধ্যে কি দেওয়াল হয়ে আছে ওই একফালি
অঙ্গ? রাগী দেবতাও অনুরাগী মানুষের স্তরে নেমে আসেন ওই বেআদব অঙ্গ নিয়ে, পুরাণের
ইন্দ্রকে ভাবুন, জিউসকে ভাবুন, মহাকাব্য এবং ইতিহাস অন্যভাবেই হয়ত লেখা হত যদি
দেবতারা জিতেন্দ্রিয় হতেন। জিতেন্দ্রিয়! কিন্তু সেই ব্যাপারটা ঠিক কী? হেনরি
মিলারের নায়ক যৌনক্রিয়ার আগে-পরে তার যৌনাঙ্গ ধুয়ে নেয়, ঠিক যেমন একজন
স্বাস্থ্যসচেতন ভোজনরসিক তার নিরপেক্ষ হাত ধুয়ে নেয় খাওয়ার ঠিক আগে এবং পরে। স্নান
করে জেগে ওঠেন দেবতা। স্নান করে কি ঘুমিয়ে পড়ে পশু, আর রাক্ষস? এবং, কেন বিবাহিত হেনরি
মিলার জড়িয়ে পড়েন অ্যানাইস নিন নাম্নী বিবাহিতা মহিলাটির সঙ্গে? যৌনতার যুক্তিতে,
নাকি যুক্তির যৌনতায়? ঠিক যেভাবে মিলার সংশ্লিষ্ট হয়েছেন অ্যানাইসের সঙ্গে, যে
ভাষায় তিনি ব্যক্ত করেছেন সেই সংশ্লেষকে, কোনো বঙ্গীয় লেখকের পক্ষে কি সেটা সম্ভব?
সম্ভবত না। আমাদের এখানে মেয়েরা যখন সাহিত্যে নিজেদের কামবাসনার কথা লেখেন, সেটা
তাঁরা পুরুষের ভাষাতেই লেখেন, যাতে পুরুষ সম্পাদক খুশি হন, এবং পুরুষ পাঠকরা
গোগ্রাসে পড়ে। এভাবেই, অগণিত মেয়ে রোজ পুরুষ হতে চেয়ে মেয়েদের মর্যাদাকে ধর্ষণ করে
চলেছেন। অথচ, হেনরি মিলারের বিরুদ্ধে ওঠে মেয়েদের ‘বস্তু’ ভাবার অভিযোগ!
১৯৩২-এ প্যারিসে দুজনের দেখা হওয়ার পর ফিরে এসে ধূমায়িত মদের ভাষায়
মিলার আনাইসকে লিখলেন- “আমাকে আর সুস্থমস্তিষ্ক প্রত্যাশা কোরো না। ল্যুভসিনে-ই তো
আমাদের বিয়েটা হয়ে গেছে- সেটা নিয়ে আর বিবাদ করতে চেয়ো না তুমি। তোমার
একটা টুকরো তো নিজের সঙ্গে সেঁটে নিয়েই আমি ফিরে এসেছি; আমি হেঁটে
বেড়াচ্ছি, সাঁতার কাটার মতো, রক্তের এক মহাসমুদ্রে, তোমার আন্দালুশিয়ান রক্ত,
চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া এবং বিষাক্ত। যা-ই আমি করি, বলি, বা ভাবি, সব ওই বিয়েটার সঙ্গে
ফিরে জুড়ে যায়। আমি দেখেছিলাম তুমি তোমার গৃহে মালকিন হয়ে আছ, ভারি মুখমণ্ডলের
একজন কৃষ্ণবর্ণ মুর, সাদা শরীরের একজন নিগ্রো রমণী, তোমার সমস্ত ত্বকে চোখ ছড়িয়ে
আছে, রমণী, রমণী, রমণী। আমি জানি না তোমাকে ছেড়ে কী করে বাঁচব- এই বিচ্ছেদগুলোই তো
মৃত্যু।” এই চিঠি বহু আলোচিত, এবং মিলার সম্পর্কে যারা জানেন, তাঁরা এই চিঠিটাও
জানেন। কিন্তু, মজার ব্যাপারটা হল, এই চিঠিতে মিলার সরাসরি অ্যানাইস নিনকে যুক্ত
করলেন পৌরাণিক ইন্দ্রের সঙ্গে। শুধু নিজের পিপাসার এই কাব্যিক এবং অসহায় সুররিয়াল
বর্ণনাই নয়, পরে খুব স্পষ্ট করে বললেন- “আমি সবচেয়ে শান্তি পাই আনন্দ পাই যখন
খাওয়ার ঘরটিতে বসে শুনতে পাই তুমি পোশাকের খসখস আওয়াজ তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছ, দেবী
ইন্দ্রের মতো পোশাক পরেছ তুমি যাতে হাজারটা চোখ বসানো আছে।” পরস্ত্রীর শরীরে
দৃষ্টিপাতের পাপে এবং শাপে দেবরাজ ইন্দ্রর শরীরে সহস্রটি চোখ হয়েছিল। যে পোশাক
অ্যানাইস নিন পড়েছিলেন, তাতে হয়ত অজস্র চোখ প্রিন্টেড ছিল। কিন্তু ইন্দ্রকে হেনরি
মিলার এখানে ‘দেবী’ (goddess) বলছেন কেন? দেবরাজ যদি দেবী
হন, শ্রীরাধিকাও প্রেমিক হতে পারেন, রতিও দেবতা হতে পারেন। এ কি মিলারের
মাইথোলজিকাল ভুল, নাকি সাইকোলজিকাল অনিবার্যতা? কিংবা, এ কি একটি মুদ্রার না-দেখা
পিঠ?
কন্দর্প হোন, বা কিউপিড, দেবতা তো মানুষের ইচ্ছার পুঞ্জীভূত আকার! কিন্তু
মিলার আর অ্যানাইসের মধ্যে কে কাকে ফুসলেছিলেন? প্রশ্নটাই অবান্তর। জন্মসূত্রে
রোম্যান ক্যাথলিক অ্যানাইস নিন সেই বিরল রমণীদের মধ্যে একজন, যারা সার্থক ইরোটিকা
লিখেছেন। রসোত্তীর্ণ কামসাহিত্যের
রচয়িত্রী তিনি। এবং, আমরা সকলেই জানি, ইরোটিকা হল মানুষের আকাঙ্ক্ষার পুঞ্জীভূত
রূপ, যদি না তা বিকৃত হয়, যদি না আড়ষ্ট হয়, প্লাস্টিক যদি না মাংসের অভিনয় করে,
যদি না তা পর্নোগ্রাফিক হয়। অ্যানাইস একদিন কিছু ফরাসি ইরোটিকার মুখোমুখি হয়েছিলেন, কিছু অদ্ভুত
পেপারব্যাক বই। সেই বইগুলো তাঁর পৃথিবী বদলে দিল। পাপশূন্যতার একটা অন্য দিগন্ত
অ্যানাইসের সামনে উন্মোচিত হল। একটা সময় এল, অ্যানাইস নিন স্বয়ং কিছু ইরোটিকা
লিখলেন। প্রথমে প্রকাশ করার জন্য তাঁর কোনো বাসনা ছিল না, পরে প্রকাশিত হল।
বিখ্যাত কিছু ইরোটিকা, যেমন ‘ডেল্টা অফ ভেনাস’, অথবা ‘লিটিল বার্ডস’, ‘আ স্পাই ইন
দ্য হাউস অফ লাভ’, ‘ইনসেস্ট’। হেনরি মিলার এবং তাঁর দ্বিতীয় পত্নী জুন মিলারের
সঙ্গে নিজের সম্পর্ক নিয়ে লিখলেন ‘হেনরি অ্যান্ড জুন’। আর লিখলেন তাঁর আশ্চর্য
দিনপঞ্জী, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং অকপট দিনিলিপি, যা একজন নারী লিখলেন, এমন
একজন নারী, যার যৌনজীবন আজও অনেকের কৌতূহলের ব্যাপার। সেখানেও হেনরি মিলার উপস্থিত
আছেন। মিলার নিজেও নাকি কিছু ইরোটিকা লিখেছিলেন, অর্থের অভাব ছিল তার কারণ,
অবিশ্যি তিনি নিজে লিখেছিলেন নাকি তাঁর নাম ব্যবহৃত হয়েছিল, সে নিয়ে বিতর্ক আছে।
অ্যানাইসের ইরোটিকাগুলো উত্তীর্ণ সাহিত্য। তাঁর ‘ডেল্টা অফ ভেনাস’ আজ একটি
আন্তর্জাতিক ক্ল্যাসিক। সেখান থেকে আমরা প্রেমের এরকম একটি বিবৃতি খুঁজে নিতে পারি- When she closed her eyes she felt he had many hands,
which touched her everywhere, and many mouths, which passed so swiftly over
her, and with a wolflike sharpness, his teeth sank into her fleshiest parts.
Naked now, he lay his full length over her. She enjoyed his weight on her,
enjoyed being crushed under his body. She wanted him soldered to her, from
mouth to feet. Shivers passed through her body. এই
গদ্যাংশটিতে কোথাও কি মনে হচ্ছে, পুরুষটিকে মেয়েটি অপমানিত করছেন, ব্যবহার করে করে
শুয়োরের মাংস বানিয়ে ফেলছেন পুরুষটির শরীরকে? না। কিন্তু সমস্যাটা হল, অ্যানাইস
তাঁর এই গদ্যে প্রসাদগুণ বর্জন করেননি।
অথচ হেনরি মিলারের ‘সেক্সাস’-এ আমরা পাই এ-রকম গদ্য- I would ask her to prepare the bath for me. She would pretend to demur but she would do it just the same. One day, while I was seated in the tub soaping myself, I noticed that she had forgotten the towels. “Ida”, I called, “bring me some towels!” she walked into the bathroom and handed me them. She had on a silk bathrobe and a pair of silk hose. As she stopped over the tub to put the towels on the rack her bathrobe slid open. I slid to my knees and buried my head in her muff. It happened so quickly that she didn’t have time to rebel or even pretend to rebel. In a moment I had her in the tub, stockings and all. I slipped the bathrobe off and threw it on the floor. I left the stockings on- it made her more lascivious looking, more the Cranach type. I lay back and pulled her on top of me. She was just like a bitch in heat, biting me all over, panting, gasping, wriggling like a worm on the hook. As we were drying ourselves, she bent over and began nibbling at my prick. I sat on the age of the tub and she kneeled at my feet gobbling it. After a while I made her stand up, bend over; then I let her have it from the rear. She had a small juicy cunt, which fitted me like a glove. I bit the nape of her neck, the lobes of her ears, the sensitive spot on her shoulder, and as I pulled away I left the mark of my teeth on her beautiful white ass. Not a word spoken. এই বহুবিতর্কিত এনং আমাদের সংস্কৃতে বিস্ফোরক গদ্যাংশটির আমি অনুবাদ করছি না, কারণ পাঠক নিজে অনুবাদ করলে বুঝবেন, ইঙ্গ-বঙ্গ অভিধানের পাতাগুলো ওল্টালেই ধরতে পারবেন, এখানে ফ্যান্টাসি এবং সত্যের মধ্যে কোনো অনুবাদ রাখা নেই, মিলার নিজেই সেই অনুবাদকে নির্মমভাবে খারিজ করেছেন। এই গদ্য, পর্নোগ্রাফির উদাহরণ নয়, কারণ এখানে কোনো মোহের অবতারণাই করেননি মিলার। এই গদ্য পর্নোমোচী, পর্নের অবসান ঘটায় এই গদ্য, পর্নের সবটুকু বিষ শেষ করে দেয়। কিন্তু এই রচনাংশটিকে অবলম্বন করেই মিলারের বিরুদ্ধে নারীবিদ্বেষ এবং লিঙ্গবৈষম্যের অভিযোগ আনা হয়েছে অনেকবার, অনেকেই এনেছেন। সম্ভবত এখানে নারীটির শরীরকে ব্যবহৃত ভাবা হয়েছে পুরুষটির শরীরের দ্বারা। সেই কাজটা খুব সোজা ছিল। বাঘ হরিণের প্রতি হিংস্র, এই হল সামাজিক ধারণা, কিন্তু হরিণও কি নয় ঘাসের প্রতি সমান হিংস্র? ক্ষুধা, পিপাসা, আর হিংস্রতার পরিসরটাকে ঘুলিয়ে দেওয়াই কিছু আলোচনার উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু, সত্যিই কি উপরের গ্রাফিক বিবৃতিটির মধ্যে কোনো পক্ষপাতিত্ব আছে?
নারীর কোনো অসম্মান আছে? ধরুন ঠিক উপরের রচনাংশটিকেই যদি আমরা পাল্টে নিই? অর্থাৎ,
যদি ঘটনাপ্রবাহ একই রেখে ওই অংশটিকে পুরুষটির বদলে নারীটির দৃষ্টিকোণ থেকে বিবৃত
করা হয়, যদি কৃষ্ণের বদলে আমরা শুধুই রাধার কথা শুনি? মিলার তা করেননি। আমরা বরং
সেটাই করি। হয়ত শুধু কিছু সর্বনামের লিঙ্গান্তর ঘটিয়ে এবং দু-একটি সহায়ক ক্রিয়া ও
বিশেষণের পক্ষ-পরিবর্তনের মাধ্যমেই আমরা মুদ্রাটাকে দু-দিক থেকেই যাচাই করতে পারব।
আমি, আমার দুর্বল ইংরেজিতে সেই চেষ্টা করছি এখানে, মিলারের গদ্যাংশটিকে
উল্টে দিচ্ছি, এখানে মেয়েটি বিবৃতি দিচ্ছেন- He would ask me to prepare the
bath for him. I should pretend to demur but I did it just the same. One day,
while he was seated in the tub soaping himself, he noticed that I had forgotten
the towels. “Ida”, he called, “bring me some towels!” I walked into the
bathroom and handed him them. I had on a silk bathrobe and a pair of silk hose.
As I stopped over the tub to put the towels on the rack my bathrobe slid open.
He slid to his knees and buried his head in my muff. It happened so quickly
that I didn’t have time to rebel or even pretend to rebel. In a moment he had
me in the tub, stockings and all. He slipped the bathrobe off and threw it on
the floor. He left the stockings on- perhaps it made me more lascivious
looking, more the Cranach type. He lay back and pulled me on top of him. I was
just like a bitch in heat, biting him all over, panting, gasping, wriggling
like a worm on the hook. As we were drying ourselves, I bent over and began
nibbling at his prick. He sat on the age of the tub and I kneeled at his feet
gobbling it. After a while he made me stand up, bend over; then he let me have
it from the rear. I have a small cunt, which fitted his big juicy cock like a
glove. He bit the nape of my neck, the lobes of my ears, the sensitive spot on
my shoulder, and as he pulled away I left the mark of my teeth on his beautiful
back. এখানে কি মনে হচ্ছে, পুরুষটির প্রতি
কোনো অপমান রাখা হল? কোনো নারী যদি এই বর্ণনা দিতেন, মনে
কি হত, তিনি এক ছদ্মবেশী পুরুষ? কিংবা, মিলার স্বয়ং কি নন একজন ছদ্মবেশী পুরুষ, যে
একজন নারী হয়েই বুঝি প্রতি মুহূর্তে ভাবছে মৈথুনকালে নারীটি তার কাছে কী চায়,
এমনকি কিছুটা জান্তবতাও কি সেই চাওয়ার মধ্যে পড়ে না? প্রকৃত মিলনে নারীটি পুরুষ
হয়ে যায়, আর পুরুষটি নারী। সেটা অশ্লীলতা নয়। ভোগসর্বস্বতা নয়। সেটা আত্মসমর্পণও
নয়, যেমন কিছু চরম নারীবাদী মানুষ মিলারের বিবৃতিটিতে দেখেছেন। সেটা পারস্পরিক
উপলব্ধির ব্যাপার, যেখানে কোনো মিথ্যা চলে না। তাই, প্রথমেই ‘pretend’ শব্দটাকে হত্যা করা হয়েছে, এবং ঘটে গেছে
পর্নোমোচন। ‘কুমারসম্ভব’-এ যা পাই, ‘গীতগোবিন্দম’-এ যা পাই, তাই পাই এখানে। শুধু,
প্রসাদগুণ নিংড়ে নেওয়া হয়েছে, সম্পূর্ণ খাঁটি, জীবনের মাদার টিংকচার এখানে নামছে,
সম্পূর্ণ স্বাদ নিয়ে, ফোঁটা ফোঁটা ফোঁটা।
মিলারের সাহিত্যে, অথবা তাঁর জীবনে, ‘pretend’ শব্দটা
সত্যিই নেই। কোনো ভান নেই। এমনকি ভান করার ভানটুকুও মিলার করতে চান না। এখানেই হয়ত
একজন হেনরি মিলার আমাদের সংস্কৃতির পক্ষে অসহনীয় হয়ে ওঠেন। এখনকার বাঙালি সমাজে
‘স্বাভাবিকতা’-র চেয়ে বিপজ্জনক কোনো ধারণা অথবা শব্দ সম্ভবত নেই। শরীরের মতো একটি
নশ্বর ধারণাকে মিলার, আশ্চর্য নিঃসন্দেহতায়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কার্যপ্রণালীর
সঙ্গে যুক্ত করেন, একজন নিঃসংশয় বাউলের মতো। পাঠককে তিনি জীবন ও যৌনতার আলাদা কোনো
ব্যাখ্যা দেন না, বরং পাঠকের প্লেটে জীবনের একটা টুকরো নামিয়ে রাখেন, সন্তর্পনে,
কিন্তু এমনই আশ্চর্য এক নিঃসন্দেহতা ও আস্থার সঙ্গে যে পাঠক সেই টুকরোকে প্রত্যাখ্যান
করতে পারে না, খুব বেশি হলে সংস্কারবশে টেবিল ছেড়ে উঠে যায়। এক
স্বর্গীয় নির্বিকারত্ব, সেখানে একজন হেনরি মিলার
পৌঁছেছিলেন, যেখানে কোনো সমালোচনা, কোনো নিন্দা, কোনো স্তুতিই কোনো মূল্য বহে আনে
না। হেনরি মিলার লিখেছিলেন, “যে লোকটা লিখছে আমি তার উপরে ভরসা রাখি, সে তো আমি
স্বয়ং- লেখক।” হ্যাঁ, একজন লেখক, যার একটা অক্ষরও লেখার প্রয়োজন ছিল না, নিজেকে
লেখক হিসেবে প্রমাণ করতে, তিনি, তিনিই, হেনরি মিলার।
পড়তে পেরে সৌভাগ্যবান মনে করছি। ঋদ্ধ হলাম।
ReplyDeleteহেনরি মিলারের অনেক নাম শুনেছি। কিন্তু পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। এই গদ্য পাঠ আরোও আগ্রহী করলো। এবার পড়তে হবে।
ReplyDeleteসমৃদ্ধ হলাম।
ReplyDeleteWow
ReplyDelete