।। একজন কাঠমিস্ত্রির
আসার কথা ছিল। তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে সিনেমা চালালাম। সত্যজিৎ
রায়ের ‘কাপুরুষ’ সিনেমাটা আবার দেখছিলাম আজ। এক যুবক এক যুবতীকে প্রেমে প্রতারণা
করল। পরে সে আবার এসে পড়ল সেই যুবতীর জীবনে। তখন সে বিবাহিতা। যুবক এবার চেষ্টা করল
যুবতীকে আবার জীবনে ফেরৎ পেতে, এবং তার ফল হল শীতল নির্মোহ প্রত্যাখ্যান। যার জীবন
সে নরক করে দিয়েছে, সে এবার তাকে তার ব্যক্তিগত নরকের স্বাদ দিল, জীবনভর ভোগ করার
জন্য। পুরো সিনেমায় আবেগের নিয়ন্ত্রিত ও গাণিতিক ব্যবহার মুগ্ধ করে। আমাদের
শিক্ষিতও করে। শিল্পীর কাজ আবেগকে ব্যবহার করা, যেমন বন্য ঘোড়ার মুখে পরাতে হয়
লাগাম। খুব কম শিল্পী সেটা পেরেছেন। কাঁদানো বা হাসানোর চেয়ে অনেক উচ্চ স্তরের কাজ
হয় এগুলো। আপনি রবীন্দ্রনাথের ‘দেনাপাওনা’ পড়ুন। চরম নিষ্ঠুর মুহূর্তেও কোনো
আতিশয্য নেই, হাসি আর কান্নার আশ্চর্য ব্যালান্সে পাঠকের চোখে জল আসে না। মন
উদ্বেল হয়ে ওঠে বিবিধ অনুভূতির মিলনে। সত্যজিতের ক্ষেত্রেও, একমাত্র ‘পথের
পাঁচালী’ ছাড়া কোনো লাগামছাড়া কান্না নেই। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা আতিশয্য। এর
ফলেই আমাদের সবকিছু দ্রুত ফুরিয়ে যায়। সাহিত্য-শিল্প সবকিছুই জন্ম নেয় একটা ত্রস্ত
এক্সপায়ারি ডেট সঙ্গে নিয়ে। আমাদের মধ্যে এই মুহূর্তে একটা নতুন প্রজাতির সৃষ্টি
হয়েছে। আমরা এখন মুখের কথাকে গুরুত্ব দিই না। মেসেঞ্জার বা ইনবক্সের কথাকে দিই,
কারণ সেটা ডকুমেন্টেড থাকে। প্রয়োজনে স্ক্রিনশট দেওয়া যায়। ফোনেও সন্তুষ্ট হই না,
সেটা রেকর্ড করে রাখি। এটা খারাপ কিছুই নয়। এর ফলেই মানবপ্রজাতি অনেক এগিয়ে যাবে,
এটাও প্রগতিরই লক্ষণ। পুরো সিনেমাটা শেষ হয়ে গেল। কাঠমিস্ত্রি এলেন না। পরে জানলাম
তাঁর সঙ্গে আগের দিন যে কথা হয়েছিল, সেটা তিনি আজ ভুলে গেছেন। আজ আমার আরেকবার ফোন
করা উচিত ছিল। এখন কেউ আগের দিনের কথা মনে রাখে না। এই ভার্চ্যুয়াল বাস্তবের যুগে
কাঠের ফার্নিচার বেশ বেমানান। কিছুদিন পরে হয়ত আমরা স্মার্টফোন পেতেই শোব, খাব,
বসব, স্নেহ প্রকাশ করব, প্রণাম ও রমণ করব। ।
অনুপম মুখোপাধ্যায়
পরিচালক- ‘বাক্’