আলোচনা- শ্যামলী আচার্য
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মা আর ছোট ছোট ভাইবোনগুলো আছাড়িবিছাড়ি কাঁদছিল। ছোটগুলো
আমার জামা ধরে টেনে রাখতে চাইছিল আর বলছিল, ও দাদা, তুই যদি যাও, তয় আমাগো কেডা
দ্যাখফে? আমাগো লইয়া মেলা দ্যাখথে যাইবে কেডা? আমরা খামু কী? পড়া দ্যাহাইয়া দেবে
কেডা? আমাগো এডা ওডা কেডা আনইয়া দেবে?
ইশ্বর, পৃথিবী, বিধাতাপুরুষকে সাক্ষী রেখে এক কিশোর ছেড়ে চলে যায় তার বাসভূমি।
এক অনাকাঙ্ক্ষিত কিন্তু প্রগাঢ় প্রস্থান। ঘরে-বাইরে তখন একটাই ধ্বনি, হিন্দুস্থান
হিন্দুর এবং পাকিস্তান মুসলমানদের। তাই চিরদিনের মতো জন্মভূমি ছেড়ে চলে যাওয়ার
সিদ্ধান্ত। গ্রামগুলি তখন শূন্যপ্রায়, ভাল লাগার মতো, মনে আনন্দ সৃষ্টি করার মতো
কিছুই আর এখানে অবশিষ্ট নেই, তবুও মাঠ, মাটি, গাছপালা, হতভাগ্য মানুষজনেরা যারা
অবশিষ্ট আছে, তারা কী ভীষণভাবেই না ওতপ্রোত।
মিহির সেনগুপ্ত তাঁর “বিষাদবৃক্ষ” আখ্যান জুড়ে বুনে যান এক পথের পাঁচালী। ১৯৬৩ সালে বরিশাল ছেড়ে,
পিছাড়ার খাল ছেড়ে, জন্মভিটা ছেড়ে বরাবরের মতো যখন বাহিরপানে, তখন শেষ বিদায় নিয়ে
মায়ের আলিঙ্গনচ্যুত এক কিশোর প্রণাম জানায় আশেপাশে সমস্ত বস্তু, অবস্তু, প্রাণী,
অপ্রাণীকে। মনে মনে বলে, ক্ষমা কোরো। নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে কোন অজানিতের পথে যাত্রা
করা অপুর মতোই তার আকুল চাওয়া ‘ক্ষমা করো। ক্ষমা করো। হে গৃহ, হে পার্শ্বস্থ
বৃক্ষ, হে লতাগুল্মের ঝপ, হে দিগন্তব্যাপী ক্ষেত্র এবং তৃণশস্প, তোমরা এই পলায়নপর,
অক্ষম জাতককে করুণা করো, ক্ষমা করো। আমি পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের আক্রমণ থেকে ওদের
বাঁচাবার জন্য দেশত্যাগ করছি’।
ইতিহাসের জৈবিক অস্তিত্বে আস্থা রাখেননি লেখক। স্পষ্ট জানিয়েছেন, তাঁর অনুভব
এবং চিন্তনের জগতে ইতিহাস এক বিশৃংখলা, এক ম্যাসাকার। সে কখনো সাম্প্রদায়িকতা,
কখনো জাতীয় স্বাধীনতা, কখনো মুক্তিযুদ্ধ এবং কখনো বিপ্লববাদী আন্দোলনের মধ্যে
আত্মপ্রকাশ করে। অবশ্যই সেইসব দমন করার নামেও তার প্রকাশভঙ্গী ভিন্ন ভিন্ন ধরনের।
কখনো মানুষের ভাল করার নামে উন্নয়ন এবং সেই উন্নয়নের বিরোধিতাও খেলার একটা ধরন। আর
এইসব যাতে করা হয়, অথবা যাতে না করা হয়, এই দুই কারণেই ধ্বংস আর রক্তপাত। এই করে
করেই হাজার বছর পার হয়। সেই হাজার বছর খেলার তথাকথিত সাফল্যকে অবলম্বন করে কেউ গর্বিত, কেউ ধ্বংস আর রক্তপাতের স্মৃতিতে লজ্জিত।
গ্রামীণ মানুষ বিধ্বস্ত হন মানবতার অপঘাতে। কারণ সেখান থেকে তো হৃদয়টা পুরো
নির্বাসনে যায়নি।
মিহির সেনগুপ্তের সম্পূর্ণ এই যাত্রাপথ এক ব্যথার জগত। বাঙালি হিসাবে বাঙালির
বিভাজন, দেশ বিভাজনের রক্তপথ বেয়ে আসে এক বোবা ব্যথা। সেই বিষণ্ণতা চারিয়ে যায়
আত্মকথনের ছত্রে। নাকের বদলে নরুনের মতো পাওয়া গেছে দেশের বদলে রাষ্ট্র। দেশ বলে
যে ধারণা বয়ে চলে, সেই চৈতন্য প্রবাহে জাত-রাষ্ট্রের পরগাছা ধারণাকে খাপ খাওয়াতে
পারেন না লেখক। নির্মোক দৃষ্টিতে নয়, সচেতন ডিসকোর্সে তিনি বাঙ্গালিজাতিসত্তার
গোঁজামিল ধরে টান দেন। ভাগ্যের খোঁজে দেশ ত্যাগ মানুষের জন্য নতুন কিছু নয়।
ইতিহাসের আদিম কাল থেকে নানা কারণেই তা ঘটেছে। গোটা বিশ্বে মানুষ ছিন্নমূল হতে
শুরু করেছে প্রথম মহাযুদ্ধের সময়, আর তা চূড়ান্ত রূপ নেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
পরে। এর বীজ হয়ত আরো বহু আগে প্রোথিত। ক্ষমতা, দম্ভ আর লোভের যথাযথ গাঁটছড়ায় যেদিন
হত্যা বা যুদ্ধ স্বার্থসিদ্ধির চূড়ান্ত উপায় হয়ে দাঁড়ায়, সেদিন থেকেই উচ্ছেদের
সূত্রপাত। লক্ষীছাড়া, শিকড়হীন, যাযাবরের মতো একভূমি থেকে অন্যভূমিতে তার পরিচয় কখনো
উদ্বাস্তু, কখনো অনুপ্রবেশকারী, কখনো বা সন্ত্রাসী।
লেখক কথা বলেন বিষাদ নামের এক বৃক্ষকে নিয়ে। সে সেই বাংলাদেশের বরিশালের দেশের
বাড়ির বড় খালপারে প্রায় দুশো বছর ধৈর্যে, স্থৈর্যে, অভিভাবকতায় দাঁড়িয়ে থেকে তার
আশ্রয়ে সকলকে পোষণ করে একসময় লোভের কুঠারে গতাসু হয়ে শেষ হয়ে গেল। সত্যিই কি শেষ
হয়ে গেল? সে তো সেই বাড়ির, সেই পাড়ার, সেই অঞ্চলের, সেই হৃৎপিণ্ডে শিকড় ছড়িয়ে এখনো
বেঁচে আছে তার নিয়ত বিষাদ অশ্রু ঝরিয়ে, লেখক যার ছায়ায় স্মৃতির তাবত অনুকণাসহ এক
অনিবার্য পরিণতি নিয়ে প্রতীক্ষা করেন। সমস্ত স্মৃতিচারণে তাঁর একমাত্র প্রতীক্ষা
এমন এক ভূখণ্ডে পৌঁছনোর, যেখানে তাঁর আর কোনোরকম অসম্মান থাকবে না। তিনি একজন
মুক্তপ্রাণ সহজ মানুষ হতে চেয়েছিলেন। তাঁর দেশের বাড়ির বড় খালপাড়ের সেই
মহাবৃক্ষটি, যাঁকে তিনি বিষাদবৃক্ষ নামে অভিহিত করেছেন, লেখকের দেশবোধের সঙ্গে সেই
বৃক্ষ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে। এ কোনও নস্ট্যালজিয়া জাত অলস মুহূর্তের ব্যাখ্যা নয়। বরং
এ এক অনিকেতর নিকেতনের সন্ধান। সেই অনিকেতকোন একক ব্যক্তি নয়, কোনো বিশেষ ধর্মীয়
গোষ্ঠী নয়, সে এক এক সময় এক এক মানবগোষ্ঠী, গভীর আঁধারে তারা একে অন্যের বিরোধী
হলেও তাদের লক্ষ্য একটাই। নিরাপদ আশ্রয়। শুধু মানুষ নয়, যাবতীয় প্রাণ এবং
অধি-প্রাণ সবাই সমগোত্রীয়।
বাঙালির ক্ষেত্রে দেশভাগ এবং স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ আর গণহত্যা,
জাতিরাষ্ট্রের নিত্যনতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এই উদ্বাস্তু প্রবাহকে একটা স্থায়ী রূপ
দিয়েছে। লেখকের লব্ধ অভিজ্ঞতায় আশ্রয় শব্দটি কি অসম্ভব যন্ত্রণার অভিঘাত। বাংলাদেশের
বরিশাল থেকে কলকাতা। সেখানে কিছুদিনের অবস্থান। পার্ক সার্কাস থেকে ১৯৬৪ সালের
কুখ্যাত দাঙ্গায় আবার ঠাঁইবদল। এবার বিরাটি। কিন্তু ব্যক্তিগত আর পরিবারকেন্দ্রিক
আখ্যান ছাপিয়ে তখন সবটাই তাঁর কাছে একটা পিণ্ড। তাঁর ভাষায়, একটা জেলিফিশের মতী।
তার আলাদা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা আলাদা অস্তিত্ব নেই। মধ্যস্বত্ত্বের বিলোপ যেমন যৌথ
পরিবার ভেঙ্গেচুরে সকলকেই বিকলাঙ্গ করেছিল, তার পরেই আশ্রহীন অনিকেত, সহায়হীনদের
তিলে তিলে দেশভাগী স্বাধীনতার ঋণশোধ। সেই আশ্রয় স্রোতের কুটো। কখনো কোনো পার্কের
বেঞ্চিতে, কখনো কোনো বস্তির এঁদোগলির ভেঙে পড়া ঘরে, কখনো শিয়ালদা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে।
লাখো লোকের ঠাঁইহীন মুক্তির উল্লাস। ধন্য স্বাধীনতা।
দেশত্যাগের যন্ত্রণা স্মৃতি আলেখ্যর পথ ধরে যে বহতা প্রকাশ ঘটিয়েছেন, সেখানে
রয়েছে বরিশাল, ঝালকাঠি আর কীর্তিপাশার গ্রামীণ জীবন, কৃষিনির্ভর গ্রামীণ হিন্দু
মধ্যবিত্ত পরিবারের আখ্যান, হিন্দু-মুসলমান বিচ্ছিন্নতা, রায়ট, দাঙ্গা, প্রাকৃতিক
দুর্যোগ। অনিবার্য ভাবে এসেছে চিরকুমার পণ্ডিত-শিক্ষক অশ্বিনীকুমার দত্তের
সান্নিধ্য। বরিশাল জেলায় তাঁর কীর্তিকলাপ এখনো মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। আমি
ব্যক্তিগতভাবে অন্তত গত বছরে চাক্ষুষ অনুভব করে এসেছি বরিশাল শহরে, বিভিন্ন গ্রামে
এখনো তাঁর স্মারকের সদর্প উপস্থিতি।
বি এম কলেজের বহু বর্ণনা পরিবারের অগ্রজদের মুখে শুনে, স্বচক্ষে দেখে
মিহিরবাবুর স্মৃতিচারণ আরো বেদনা বাড়ায়। বুঝতে পারি, একটা সমাজ ভাঙ্গার পর যে
তলানিটুকু থাকে, তার কোনো জীবনমুখী বহতা থাকে না। সমাজের একদার সাংস্কৃতিক, নৈতিক
বা ব্যবহারিক স্বাভাবিক শুদ্ধতাবোধ সেই সময় নষ্ট হয়ে পড়েছিল। আত্মরক্ষা আর আশ্রয়
বড় বালাই। আত্মসম্মান, সাহস, স্বাভাবিক সম্ভ্রমবোধ সব হারিয়ে মানুষ তখন
লক্ষ্মীছাড়া। তারা তখন বেঁচেছিলেন জৈবিক নিয়মে, হতাশার বীজ বপন হয়েছে, পূর্বজ
অনাচারের ঐতিহ্য পরম্পরায় গিয়ে আঘাত করল। একের পর এক জনপদ তখন রাজনৈতিক
অবিমৃষ্যকারিতায়, সামাজিক অসাম্যের পাপে ছারখার। স্মস্ত বইটি জুড়ে এক আশ্রয়হীনতার
ভার। এমনকি সত্তর দশকের উত্তাল পশ্চিমবঙ্গের টালমাটাল অবস্থাতেও লেখক জড়িয়ে পড়েছেন
সক্রিয়ভাবে। দুটি পর্বে গ্রথিত এই বইটির পরিক্রমা ২০১১ পর্যন্ত। সম্পূর্ন
যাত্রাপথের শেষে বড় বেদনা জেগে থাকে। বিষাদসিন্ধু ঘিরে ধরে। বাংলাদেশ আর দেশভাগের
যন্ত্রণায় প্রচুর লেখা পেলেও এই নিহিত বিষণ্ণতা বড় জরুরি। আমাদের অস্তিত্ব আর
মূল্যবোধের কাছে এ প্রয়োজনীয়।
“বিষাদবৃক্ষ”
মিহির সেনগুপ্ত
আনন্দ পাবলিশার্স
No comments:
Post a Comment