প্রস্তাবনাঃ
এইমাত্র আমার ছবিতে যিনি লাইক দিলেন তার সাথে আমার বাবার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। উনি বাবার জীবনে এলে আমি পৃথিবীতে আসতে পারতাম না। আর আমি না এলে এই পৃথিবীর অনেক কিছুই অন্যরকম হত। অনেক মানুষ অনেক মানুষের সাথে যোগাযোগই করে উঠতে পারতোনা । আমি অনেক সম্পর্কের যোগস্থাপক। আমার জন্ম এই পৃথিবীতে অবিশ্বাস্য কিছুই নয়। আমি স্পেশাল ব্যাক্তিত্বও নই। আসলে আমাদের প্রত্যেকের জন্মই এই পৃথিবীর পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ। আমি না থাকলে কী হতো এরকম ভাবনাটা শুধু ভাবনাই। অতএব লেটস কাম টু দ্য পয়েন্ট।
যা এই মূহুর্তে লিখিত হচ্ছে তা আসলে আনন্দের কথা বলে। এবং আনন্দ একটি আবেগের নাম। আজকাল আবেগ বাদ দিয়ে অনেকে লেখালেখির কথা বলছেন , কবিতাতে কোনো আবেগ থাকবেনা , মিনমিনে - ফ্যাঁচফেচে উপন্যাস লিখিত হওয়ার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু আমি জানি , আবেগ ছাড়া কিচ্ছু হয়না। আমাদের প্রত্যেককে পরিচালিত করে আবেগ। যাহা কখনো কখনো বেগবান হয়ে ওঠে। অথচ তারও 'আ' আছে অর্থাৎ আনন্দ আছে। আর আমরা পৃথিবীতে সারাজীবন আনন্দের সন্ধান করেই কাটিয়ে দিই।
হয়তো আনন্দপুর অনেক দূর। হয়তো নেই। হয়তো আছে। যেমন আমরা আছি , আমার এই কাহিনীটি আছে।
১
ধ্রাক করে নাকে ধাক্কা মারলো গন্ধটা। বাসে করে কোথাও যাওয়ার সময় কোনো কোনো জায়গা থেকে জানালা দিয়ে এরকম গন্ধ পাওয়া যায়। বিশেষত ইউনিভার্সিটি যাওয়ার সময় ঐ রাস্তায় একটি নির্দিষ্ট এলাকায় রাস্তার ধারের নয়ানজুলি থেকে গন্ধটা আসে। অনেকে নাকে রুমাল চাপা দেয় , কেউ কেউ বলে ,'দেশটা মাইরি ভাগাড় হয়ে গেলো শালা!" কিন্তু এই বন্ধ ঘরটি আমার, আর এটা ভাগাড় নয়। তাহলে গন্ধটা?
জানালার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে কচুপাতা লক্ষ্য করে থুতু ফেললাম। কোনো বাজে গন্ধ আমাদের নাকে এলে আমরা থুতু ফেলি। এতে কি গন্ধটা দূর হয়ে যায়? হয়না তো! তাহলে? আসলে এটা ছোটোবেলায় মা শিখিয়ে দেয় , বা হয়তো অন্যের দেখে শিখে ফেলি। অর্জন করে ফেলি এই প্রতিবর্ত ক্রিয়াটি। কিন্তু মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থুতুটির কী হলো তা আর দেখা হয়না। দেখার কথা মাথাতেই আসেনা। আমি দেখলাম , থুতুটা স্লিপ খেয়ে কচুপাতা থেকে গড়িয়ে আর একটা বাচ্চা কচুপাতায় জমা হয়ে থাকলো।
কিন্তু গন্ধ তো দূর হয়নি! তার উৎসটি খুঁজতে হবে। বাইরে কি ইঁদুর মরেছে? নাকি আমার ঘরেই কোনো কোণে ব্যাটা পটল তুলে বসে আছে। অবিশ্যি মৃত্যুর পর কেউ আর বসে থাকেনা। শুয়ে থাকে। চিরনিদ্রা।
কোমর বেঁধে নেমে পড়লাম মাঠে। মানে ঘরেই আরকি। খুঁজতে হবে। যেই মরে থাকুক , খুঁজতে হবে। কিন্তু দশমিনিট ধরে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিচ্ছু পাওয়া গেলোনা। বাইরেও বেরিয়েছিলাম। উহুঁ! গন্ধটা খুব সন্দেহজনক বটে! উৎস নেই। একটা অসন্তোষ মনে খচখচ করে বিঁধে রইলো।
ঘড়ি দেখলাম। বাপরে! সাড়ে ন'টা বাজে! কলেজে যেতে হবে। পোনে দশটার বাস মিস্ করলে দশটা দশেরটা অনেক দেরী করিয়ে দেবে। পাঁচমিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নিলাম। স্নান আজ করা যাবেনা। ঠান্ডাটা ভালোই পড়েছে। অতএব মা'য়ের বেড়ে দেওয়া দুদলা ভাত এবং তারপর দৌড়। এই কনকনে শীতের মধ্যে মরা পচা গন্ধটা আসছিল কোথা থেকে তা আমার সারা মুখে চিন্তার একটা ভাঁজ ফেলে রেখেছে। মা'কে গন্ধটা সম্পর্কে কিছু বলিনি। কিন্তু আমার বাস ধরতে যাওয়ার রাস্তাটুকু আমায় ওটাই ভাবিয়ে গেল। আচ্ছা এটা নিয়ে এতো ভাবছিই বা কেন?
ঘড়িতে আর দু মিনিট সময়। আর একটু পথ। পৌঁছতেই হবে। যাহ! সকাল সকাল চাঁদুদার মুখটা দেখে ফেললাম। মা আমার মগজের মধ্যে ছোটোবেলা থেকেই অজস্র কু সংস্কারের সঙ্গে এটাও ঢুকিয়ে দিয়েছেন যে মোড়ের মাথার চাঁদুদার মুখ দেখে সকালে কোথাও বেরোবিনা।
আমি হেসে বলেছিলাম ," তাহলে ঐ জায়গাটা দিয়ে তো আমি যেতেই পারবোনা। কেননা উনিতো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেই পারেন এবং ওঁর মধ্যে প্রব্লেমটা কোথায়?"
"ওদের বাচ্চা হয়নি। ওদের মুখ সকাল সকাল দেখে যতবার বেরিয়েছি ততবার দিন খারাপ গেছে। তোর বাবা যদি কোনোদিন ওর মুখ দেখে দোকানে যায় তাহলে ব্যবসা খারাপ গেছে সেদিন, বা কিছু একটা যা গোটা দিনটাকে খারাপ করে দেয়। আমি তোর সাথে এই নিয়ে তর্ক করতে পারবোনা।"
"উফ্ মা, তাহলে লোকটা যদি বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়েই থাকে আর আমাকে ওইদিক দিয়েই যেতে হয় তখন কি করবো?"
"মুখ নিচু করে যাবি ওখান দিয়ে।"
আজ শালা মুখ নিচু করার কথা মনেই আসেনি। ঐ গন্ধটা খুব ভাবাচ্ছে। তার সাথে লেট। অথচ লোকটার তো কোনো দোষ নেই , রিটায়ার্ড পার্সন , সকাল সন্ধ্যা বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফোঁকেন। ফুকতেই পারেন, ওর বাড়ি ওর গেট --- কিন্তু বাসটা মিস্ হয়ে গেছে। সুতরাং মা'য়ের কথা মিলে গেলো। এটা আসলে আমার মনের কমপ্লেক্স। নিজের দেরী হওয়ার দোষটাকে অন্যের ওপর চাপিয়ে লাঘব হওয়ার ধান্দা। আমি তো কিছুই করিনি, সব উনি করেছেন , আমি নিমিত্ত মাত্র।
গীতা মাইরি মাঝেমাঝে অন্য ভাবেও ব্যাখা করা যায়।
২
যেকোনো গল্প বা উপন্যাস লিখতে গেলে আগে একটা চরিত্রকে ভালো মত এস্টাব্লিশ করতে হয়। আমি এই কাজে অক্ষম। আমি নিজেকেই নিজের লেখায় নিংড়ে দিই , কিন্তু নিজেকেও ঠিকঠাক এস্টাব্লিশ করতে পারিনা। যে নিজেকেই লিখতে পারেনা সে অন্য কারোর কথাও লিখতে পারবেনা। বাঙলায় একটা প্রবাদ আছে , একবার না পারিলে দেখো শতবার , অতএব লিখতে তো আমায় হবেই। পৃথিবীতে কোনো কাজই ঠিকমতো করতে পারিনি। শুধু দুচার কলম লিখতে জানি , আর লেখার ঘোরটাকে আঁকড়ে বেঁচে থাকতে জানি। তাই চরিত্র এস্টাব্লিশ না হলেও লিখে যাব। বাস মিস্ হয়ে যেতে পারে , কিন্তু লেখা মিস্ হলেই গেলো।
সেই যে বাস ধরতে পারলাম না , মনের মধ্যে আবার একটা কেমন অস্বস্তি শুরু হয়ে গেল। জীবনে কি কিছুই ঠিকঠাক সময় মত ধরতে পারবোনা? দোষ তো চাঁদুদার নয় , দোষ ঐ গন্ধটারও নয় , দোষ সময়েরও নয় যে সে আমার থেকে জোরে দৌড়য়। দোষ একান্তই আমার। আমি পারিনি , আমি অসফল।
মোড়ের দোকান থেকে একটা চারমিনার কিনে ধরালাম। ফেলুদার ব্র্যান্ডের এখন চল কমে গেছে। তবে আমার কাছে এটাই বেস্ট। ওর চেয়েও বড় কথা হল, দাম। এটা খানিক সস্তায় মেলে বলেই। দিনের প্রথম বিলাসিতা। স্ট্রেস নিয়ে ফেলেছি। কমাতে হবে। কুলকুল করে সারা শরীরে ধোঁয়া ছড়িয়ে দিলাম। আহ্ , শান্তি! বাস স্ট্যান্ডের বসার জায়গাতে আয়েশ করে বসলাম। পরের বাসের অপেক্ষা। তার মাঝের টাইম পাস।
মেয়েটাকে তখন থেকেই দেখছি। আমার পাশেই এসে বসেছিল। আমারই মত বাসের প্যাসেঞ্জার হয়তো। আসলে আমি তো এই বাসে খুব কম যাই। পৌনে দশটার বাসটাই আমার জন্য বরাদ্দ , তাই অন্য কোনোদিন ওকে দেখেছি বলে মনে পড়েনা। মেয়েই বলব? আমার থেকে অনেকটাই বড় , এবং সিঁথিতে সিঁদুর , তাহলে বউ বলাটাই বাঞ্ছনীয়। জাতিতে আদিবাসী তা মুখের গড়ন আর গায়ের রঙ বলে দিচ্ছে। কিন্তু একটা অদ্ভুত সৌন্দর্য আছে ওনার মধ্যে। বছর পচিঁশেক বয়স হবে সম্ভবত। আমার পাশেই যেহেতু বসে আছেন তাই ঘনঘন তাকাতে পারছিনা। হাতে একটা টিফিন বক্স। স্টিলের।
শাড়ির ওপর বেগুনি সোয়েটারটা দারুন সুন্দর। চুল গুলো টেনে টেনে আঁচড়ানো। সিগারেটটা শেষ হয়ে গেছে। মোবাইল বের করে সময় দেখলাম। আর পাঁচ মিনিটেই বাস আসবে। উনি আমার পাশ থেকে উঠে মিষ্টি রোদের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালেন। খুব সুন্দর রোদ উঠেছে। হাল্কা হাল্কা। তার মধ্যে বেগুনি সোয়েটার ঝকঝক করছে। বাস ঢোকার সাথে সাথে উঠে পড়ার প্রস্তুতি। আমিও উঠে দাঁড়ালাম এবং সাথে সাথেই বাস এলো। প্যাসেঞ্জারদের ব্যস্ততা তুঙ্গে। ছুটলাম। উঠে জায়গা নিতে হবে এবং কায়দা করে ঐ বউ টিকেও জায়গা করে দেওয়ার একটা ইচ্ছে মনের মধ্যে দানা বাঁধলো হঠাৎ। রোগা হওয়ার একটা সুবিধা আছে। ঝটাপট ফাঁকফোকর গলে ভীড় কে বুড়ো আঙুল দেখানো যায়।
কঠোর তপস্যার পর পাওয়া বরের মতই জানালার ধারে সিটও পেয়ে গেলাম। দরজার ঠিক পিছনে। এতজনের মধ্যেও আমার চোখ ঐ আদিবাসী রমনীটিকেই খুঁজছে। উনি এখনো উঠতে পারেননি। ঐ এবার উনি উঠছেন , কিন্তু একটা বেঢপ ভুড়িওয়ালা লোক ওকে ধাক্কা মেরে নিজে আগে ওঠার তাল করতে গিয়ে বউটার হাতে ধরা স্টিলের টিফিন বক্সটা পড়ে গেলো রাস্তায়। সেটা গড়িয়ে গড়িয়ে নালার দিকে যাচ্ছে। আমার চোখ একবার টিফিনবক্স একবার বউটার দিকে।
যেকোনো চলমান বস্তু বাঁধাপ্রাপ্ত
হলে তার গতি কমে যায় এবং শেষ মেশ থেমে যায়। টিফিন বক্সটিও চাকার মত গড়াতে গড়াতে নালার পাশের একটা পাথরে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। শুধু থেমেই ক্ষান্ত হয়নি , পর্দারও উদ্ঘাটন করে দিয়ে গেল। টিফিন বক্স খুলে গেছে। ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছে সাদা পান্তা ভাত। জল গুলো গড়াচ্ছে , নালায় পড়ছে চুইয়ে। এতোদূরের জানালা থেকেও আমি সবটা দেখতে পাচ্ছি। পান্তা ভাতের গন্ধটাও যেন সকালের সেই পচা গন্ধটার মত আমার নাকে এসে ধাক্কা মারলো , এত দূর থেকেও। হয়তো এটুকুই সম্বল ছিল টিফিনের। হয়তো আর কিছু কিনে খাওয়ার পয়সা নেই ওর কাছে। আমার চোখ রমনীটির মুখের প্রতিটি ভাঁজে ফিরে এলো। চরম হতাশা - রাগ - লজ্জা - দুঃখ মেশানো একটা অদ্ভুত এক্সপ্রেশন ওর মুখে ছড়িয়ে গেছে নিমেষে।
এ আমি কী দেখে ফেললাম! কেন দেখলাম আমি! হুহু করে অজস্র কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমি এখন ভদ্রমহিলার দিকে দেখছিনা। শুধু মুখের ভাঁজ গুলো ---- এক্সপ্রেশন ---- এতোগুলোর মিশ্রন ওর মুখে একসঙ্গে ছাপ ফেলছে! এটা আমি কোনোদিন লিখতে পারবোনা , এই দৃশ্যটা শুধু আমার মগজে গেঁথে যাচ্ছে সুনিপুণ ভাবে। এক্সপ্রেশন! ওহ্ , আমি আর কিছুই ভাবতে পারছিনা। এই ছবিটা একমাত্র 'তার' দেখা উচিৎ ছিল। আমি এ নিয়ে পৃথিবীতে কোনো কাজই করে যেতে পারবোনা , অথচ এটা নিয়ে যে কেউ কাজ করবে সেটাও সম্ভব করতে পারবোনা। আমি কত স্বার্থপর! শিল্পীরা স্বার্থপর হয়। একজন দরিদ্র মানুষের দুপুরের খাবার নষ্ট হয়ে গেল , সে হয়তো আজ দুপুরে খেতেই পারবেনা কিছু , অথচ আমি শিল্প নিয়ে ভাবছি! ওই এক্সপ্রেশন!
বাস থেকে নেমে পড়লাম। অনেক কিছু আমার মনের ছোট্ট আরশীনগরে ভেসে উঠেছে। যা আমাকে তাড়িয়ে বেরাবে। কলেজে গিয়েও ক্লাসে মন বসাতে পারবোনা , কোত্থাও কিচ্ছু ভালোলাগবেনা আজ। আমি জানি। অনেক ঘটনার একসাথে চ্যাপ্টার খুলে দিচ্ছে মন নামক রহস্যময় অবয়বটি। পাঠক হয়তো ভাববে , এ শালা কেমন পাবলিক! একটা সামান্য ইনসিডেন্ট একটা ছেলের সারাটা দিন নষ্ট করে দেবে! দিতে পারে? যেখানে তার বিন্দুমাত্র হাত নেই! কিন্তু আমি কাকে বলবো আমার এ অবস্থার কথা। হয়তো সাধারণ মানুষের কাছে আমি অসাধারণ , অর্থাৎ অস্বাভাবিক। কিন্তু আজ আমি কিছুতেই কলেজে যেতে পারবোনা। এই সমস্ত চ্যাপ্টার গুলো ভাসিয়ে দিতে হবে মন থেকে , চিরতরে। রাস্তা খুঁজছি , হারিয়ে যাওয়ার। যেখানে আমি হারাতে পারি ঐ এক্সপ্রেশন থেকে মনে পড়ে যাওয়া ঘটনার পরম্পরা।
একটা দীর্ঘ সুতো , ওটা আমাকে ছিড়ে ফেলতেই হবে।
সুনিপুণ লেখা। ভীষণ ভাবে বিস্মিত হবে যেকোনো পাঠকই।।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Delete