।। বাক্‌ ১২৪ ।। কথোপকথন ।।






অমিতাভ মৈত্র ... হাসি ঠাট্টা থাক। এবার এমন কিছু কবিতা পড়া যাক, যা উন্মুখ তৃষ্ণা সত্ত্বেও, এজন্মে আর লেখা হবেনা আমার। যারা লিখেছে তারা বয়সে অতি তরুণ। সাতটি বিস্ময় চিহ্ন, সাতটি রুদ্ধশ্বাস- আমার কাছে তারা এরকমই। যেন সাতটি অনিঃশেষ নৌকা বালি সরিয়ে জলের সন্ধানে হাঁটছে- শব্দের মরীচিকা তৃপ্তি না খুঁজে- আর সূর্য নামছে মৃত বৃষটিকে আলো দেখানোর মতো। এ জীবনে তো পারলাম না। পরের জন্মে আমি যেন এসব কবিতা লিখতে পারি।

         ১।এক জন্মের চাবি/ অন্যজন্মের তালার কাছে নিয়ে আসি/ এই দরজা
           কখনও না খোলার জন্য

         ২। এভাবে একদিন আমিও খসে পড়বো/ একটা টিকটিকির আত্মরক্ষার
            কৌশল থেকে/ আরেকটা টিকটিকির পরিচয় হীনতায়

         ৩। শিকারির আবেদনে আমরা কামড় বসাই/ দেখি আবেদনের সুড়ঙ্গে
            পোকা চলে গেছে/ আর অসুখ ক্রমশ আকার নিয়েছে আপেলের/
            যে ছুরি দুদিকেই ধারালো

এক বিকেলে মাঠে বসে কবিতা শুনছিলাম যে সনাতন বিস্ময়চিহ্নের মতো কবির তাদের মধ্যে ছিল দীপ্তপ্রসাদ সিংহ নামে একজন, যে এই কবিতাগুলো মোবাইল থেকে পড়ছিল। সেই সনাতন তরুণ কবির মধ্যে সে-ই ছিল; সম্ভবত, তরুনতম। রোগা, লম্বা, বড়বড় চোখ, একটু লাজুক মুখে পড়ে যাচ্ছে সে। কয়েকদিন পরে পিঠে স্কুল ব্যাগ নিয়ে ওকে দেখলাম। জানলাম ও এগারো ক্লাসে পড়ে। ভাবা যায়! সেই বিকেল ছিল কবিতার আর সেই বিকেলে ছিল জয়দীপ মৈত্র – “বেহালা হল সেইসব গাছ যার গুঁড়িতে/ কোনও বিকেলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দুটো মানুষ / পাশাপাশি খোদাই করছিল নাম” এর সাথে পড়েছিল “দরজা মানে/ ঘুরিয়ে বলা কোন ভাঙা কাচ”। ছিল লাজুক, অন্তর্মুখী “হারানো বেহালার নাবিক” সজল দাস, যে পড়েছিল “ কর্মে আসে যে ঘুড়ি তাকেই বেলুন বলি/ এমনিতে, একটা সময়ের পর/দুজনেই উড়তে পারে না”। অথবা “ নবম শ্রেণির নৌকা/ যখন নবম শ্রেণির অঙ্ককে ভিজিয়ে দেয়/ তখনও কি আমরা রোগা মাস্টারমশাইয়ের দূর দৃষ্টির কথাই ভাবব!” আমি বিস্মিত হয়ে শুনছিলাম এদের। বিকেলের সূর্যও বিস্মিত হয়ে সুঞ্ছিল,আর ডুবে যেতে সময় নিয়েছিল অতিরিক্ত কয়েক মিনিট।

অনুপম - ভাল লাগলো কবিতাগুলো। বাহুল্য নেই, বিলম্বিত বিশ্লেষণ নেই। যে মুহূর্তে কবিরা বুঝেছেন আর এক পাও ফেলার দরকার নেই, তাঁরা ছেড়ে দিয়েছেন লেখাটিকে। লাবণ্য যোজনা করে দীর্ঘ করেনি। এই প্রবণতা অনেক তথাকথিত বড় কবির মধ্যেও আমরা দেখতে পাই। এক লাইন কবিতাকে দশ লাইনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আমরা বহু মহৎ রচনাকে নষ্ট হতে দেখেছি। এক সময় জয়দীপ আর দীপ্তর সঙ্গে অনেক কথা হত। ওদের কবিতার দিকে আজও আমি চেয়ে থাকি। খুব কম লেখে মনে হয়। দীপ্তর লেখা তো বহুকাল হল কিছু পড়িনি। 'কম বয়স' বলে কিছু হয় না। দীপ্ত খুবই শক্তিশালী নাম। জয়দীপ সম্পর্কেও একই কথা।

অমিতাভ - হ্যাঁ। জয়দীপের একটা কবিতায় যেন এই সব কবিতার মর্মরূপ ধরে রাখা আছে। “গভীরতার কথাই বলতে চেয়েছিল/ এই হিমবাহ/ সমুদ্র তাকে দিয়ে কেন যে জাহাজডুবির অভিনয় করাল”। জাহাজডুবির এই রুদ্ধশ্বাস অভিনয় কখনও কখনও আমরা কবিতায় দেখতে পাই তো! খুব সূক্ষ্ম, খুব বাস্তবতামাখা। অভিনয় বলে মনে হয় যেন। কিন্তু এই অভিনয় কবিতার সহজ সাধারণ সত্যেরই প্রলম্বিত এক অদ্ভুত কিছু হয়ে ওঠে তখন। কিন্তু গভীরতার কথা বলা হয়ে না তার। প্রলম্বিত করার উৎসাহে তার জিভ ছিঁড়ে গেছে কখন!

অনুপম-  এবং জয়দীপের এই উচ্চারণ খুব সিনেম্যাটিক। আপনি প্রায়ই বলেন, ঘাটালে থাকার সময় এটা নিজে লক্ষ্যও করতাম, কবিতার থেকে গদ্যই বেশি পড়েন আপনি। আমি নিজেও কবিতা পড়ি কম। ছবি দেখি বেশি। সিনেমা দেখি বহু। কবিতার চেয়ে গল্প-উপন্যাসে বেশি সময় দিই। কবিতা যখন কোনো কবিতাকে ট্রিগার করে, তার মধ্যে এক কণা হলেও চোরাবালি লেগে থাকে। অন্য শিল্পমাধ্যমে সরাসরি গুলি খাওয়ার রিস্ক থাকে না। বার্গম্যান বা আন্তোনিয়নি যখন কোনো কবিতা উসকে দেন, সেখানে একরকম প্রভাবিত হয়েও না হওয়া যায়। অহোরাত্র কবিতা লেখেন বা পড়েন যাঁরা, তাঁদের অনেককেই নিজের দশকের ধারায় ব্যস্ত দেখা যায়। স্রোতহীন একটা ধারায় তাঁরা নিরাপদ বোধ করেন। কিন্তু আপনার চার দশক পরের কবিতাও আপনাকে এত টেনে রাখছে, এটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। কবিরা তো তরুণদের অভিভাবক হতেই আকুল থাকেন, পাঠক হয়ে ওঠা তাঁদের হয় না। অথচ, একজন কবির ত্রাস কিন্তু তাঁর পরের প্রজন্মেরই হওয়ার কথা। কবিকে বধিবে যে, শিশুসদনে বাড়িছে সে... হা হা...

অমিতাভ - হা হা হা হা হা... এটা দারুণ বলেছ অনুপম। কী জানো, কারণটা খুব সিম্পল। এই যাদের কবিতা নিয়ে আমরা কথা বলছি, তারা হয়তো ৩৫/৪০ বছরের ছোট আমার থেকে, কিন্তু তারা কোন দশকের এটা আমি জানি না। এইসব দশকটশক ভাগ আমার দাড়ি গোঁফে উলঝুলো মুখে “নারীর হাস্যের মতো অবান্তর লাগে”। দশক নিয়ে সবারই খুব মাথাব্যাথা কেননা দশক কপালে একটা বিষহরী কবচ ঝুলিয়ে দেয়, একটা শনাক্তকরণ চিহ্ন দেয়, যা না থাকলে তাঁরা বিপন্ন, যা চলে গেলে তাঁরাও হারিয়ে যেতে পারেন বলে ভাবেন। কোন দশকের মধ্যেই এমন কোন সাধারণ লক্ষণ নেই যা সেই সময়ের সবাইকে চেনাতে পারে। পঞ্চদশ সুনীল-শক্তির পাশে বিনয়, তারাপদ বা সুধেন্দু মল্লিক কবিতা লিখেছেন নিজেদের মতো। সুধেন্দু মল্লিক , যিনি খুব অনুচক্কিত ধার্মিক কবিতা লিখেছেন (ওঁর বইয়ের নাম ছিল “সঙ্গে আমার বালকৃষ্ণ”) তিনিও কোনও দৈবী পরিবর্তনে “কৃত্তিবাস” এ লিখেছিলেন “ও মাসে খাবো কেবল মদ, এ মাসে খাবো গাঁজা। / ও মাসে হয়ো গর্ভবতী , এ মাসে থাক বাঁজা”। এ সব একধরণের সহাবস্থানের ফল হয়তো। নাহলে বেশ গোলমালে পড়ে যাবো অনুপম! তো,এই হচ্ছে দশক! মাথায় থাকুক দশকের টীকাকরণ, আবার কবিতায় ফেরা যাক।এই শূন্যতা/আসলে সঞ্চয়ের অভিপ্রায়/জলের যত কাছে চাই/ প্রিয় কোন গান মনে পড়ে.” শঙ্খদীপ করের এই কবিতার প্রথম দুলাইনে আমার ধারণাতীত নতুনতায় মিলিয়ে এক করে দিচ্ছেশূন্যতাও সময়ের অভিপ্রায়কে। কতো অতল গভীরতা থেকে উথে এসেছে এই অনুভূতি! পড়তে পড়তে গায়ে কাঁটা দেয় যেন। অথবা এই কবিতা –“ দু-চাকা একসাথে/ দু-চাকা দূরত্বে/ সাইকেল এগিয়ে যায়/ সাইকেল এগিয়ে যায়!” দুটো চাকার অবস্থান - তাদের সংযোগ অসংযোগ –আর গতির জন্ম যেন নিম্নরেখা দিয়ে বুঝিয়া দেয় কবিতাটি। অথবা এই সাধারণ পদার্থ বিদ্যার বিষয় থেকে,একইসাথে, ১৮০ ডিগ্রি মুখ ঘুরিয়ে এমন কিছু একটা বলে যা তারাই শুনবে, শ্রবণ আছে যাদের। অনেক কবিতা পড়া হচ্ছে। তবু এই কবিতাটি একটু পড়তে ইচ্ছে করছে, অনুপম। পড়া যাক? 

অনুপম- হোক। আপনার খুশি অনুসারে হোক।

অমিতাভ- “দুপুরে যখন কেউ থাকেনা বাড়িতে তখন বিটু ওদের পুরনো জলের জাগের মাথায় টুপি পরিয়ে তাকে বাবা সাজায়। তারপর টেবিলের ওপর জগটাকে বসিয়ে উল্টোদিকের ছোট চেয়ারে বসে একমনে কথা বলে বাবার সাথে। মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে অল্প হাওয়া দেয়। সেই হাওয়ায় বিটুর বাবার টুপি অল্প অল্প দোলে।“ কবিতাটির নাম সেক্টর ফাইভ। পরিপূর্ণ একা এক শিশু পরিপূর্ণভাবে শূন্য কোনও ফ্লাটে জগের ওপরে টুপি বসিয়ে বাবার কল্পিত উপস্থিতি খুজে নেয়। গৌতম সেনগুপ্তর “সহজপাঠ” (ফেব্রুয়ারী১৯৯৭) থেকে কবিতাটি পড়লাম। চার ইঞ্চি লম্বা তিন ইঞ্চি চওড়া সর্বমোট আট পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ছয় পাতায় আছে ছয়টি কবিতা। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের “মিনিবুক” এর প্রচার সর্বস্বতাকে চপেটাঘাত করে যেন এই ধ্যানগ্রন্থটি। সে যাক। এতক্ষণ যে সব কবিতা পড়লাম তাদের মধ্যে কোনোভাবে যেন রেমব্রান্টের কিয়ারসক্যুরো(বা আলোছায়া)র দর্শনের মিল পাওয়া যেতে পারে। বিশেষ কোনো বস্তুকে উজ্জ্বল করে তোলার জন্য আলো আসে। তারপর সেই আলো আস্তে আস্তে  অন্ধকারের নিশ্ছিদ্রে মিলিয়ে যায়। কিন্তু সেই অন্ধকারের ও আছে নানারকম রঙ, যার জন্য কোনকিছুই অপ্রধান হয়ে যায়না। লাল টমেটো, লাল গেট, লাল ঠেলাগাড়ি থেকে সজলের কমে আসা ঘুড়ি, শঙখদীপের সাইকেল-সবকিছুর মধ্যে যেন নিঃশব্দে আলোছায়া দাঁড়িয়ে আছে। “জল কতটা সাধারণে অসাধারনে/নেমে যায় প্রতিদিনের ভিতর”- তাই না! (জয়শীলা গুহ বাগচীর একটান আদন্ত্য সেরিব্রাল বই “ফুল্লরার কলের গান” ২০১৮ এর জানুয়ারীতে এসেছে। ওপরের দু লাইন উদ্ধৃতি ওর কবিতা থেকে।) জয়শীলার কবিতা পড়া যাক একটু? “আমাদের রোমকূপে কোনো জুলিয়াস নেই। স্পার্মের দৌড়কে বাড়িয়ে তোলার ফ্যান্টাসি শেষ পর্যন্ত একটা ভেজা দিনের মতো জানালা হয়ে অথে। জানালারাও আজকাল কমলাদি বা মালা। সুতির ছাপায় ঘেম প্রিন্ট অচেনা করেও যাচ্ছে এক একটা গোটা মানুষ এই তো সামান্য ছেদ...বিন্দু থেকে বিন্দুতর। এরপর পয়লা বৃষ্টি, নদী ডুবে যাওয়া, অথবা পলির ভেতর একটি, একটিমাত্র কমলাদি গজিয়ে ওঠার খবরাখবর নিতে নিতে ক্লাসরুমের ভূত ভবিষ্য শেষ হয়। মাসান্তে সিলেবাসের বেল পড়ে।" -চমকে দেয় কবিতাটি। নারীদের নিজস্ব পৃথিবী প্রচ্ছন্নে আছে কথাও। দৌড়কে বাড়িয়ে তোলার ফ্যান্টাসি শেষ পর্যন্ত একটা ভেজা দিনের মতো জানলা হয়ে অথৈ”-এমন নিবিড়, শব্দের এমন সিহর,এখানেই আমার জন্য কবিতাটি রাখা আছে।

অনুপম- ঘোর লেগেছে আপনার... মাসুদার রহমানের কবিতায় এই ঘোর থাকে... প্রায় শারীরিকভাবে পড়তে হয় ওঁর কবিতা। নদীতে নেমে নদীকে বোঝার মতো। সেখানে 'নিজস্ব পৃথিবী' একটা বাঙময় ব্যাপার।


অমিতাভ- হ্যাঁ। ঘোরই তো। শারীরিক পাঠ। তুমি মাসুদারের কথা তুললে আর আমার মনে পড়ে গেল, “একজন ডাচ সৈনিকের মৃত্যুদিনে আমাদের শহরে/লোডশহরে/বেড়ে যায়/প্রতিবার মোমবাতি জ্বালতেই ভুলে যাওয়া দিনটাকে, মনে পড়ে/ শরীরে আগুন নিয়ে মোমের গলে যাওয়া দেখি/সামনে সাদা মোম মৃত ডাচ সৈনিকের বিধবা স্ত্রী” (ডাচ সৈনিকের বউ) মাসুদার রহমান এর এই কবিতা কয়েক সংখ্যা আগে কবিতাপাক্ষিক এ ছিল আরো কয়েকটি কবিতার সাথে। “সকালের সংবাদ” নামের প্রথম কবিতাটি চমৎকার,যার শুরু হয়েছে এভাবে- “লাফিয়ে নামছে অজস্র আলোর বল এবং ছড়িয়ে যাচ্ছে, নানা দিকে/ যার দু-একটি এসে ঢুকলো আমার চোখের ভিতরে”। দুটো কবিতার মধ্যেই একটা ভিসুয়াল আন্ডারটোন রয়েছে। অন্ধকারে একটা সাদা মোম জলছে-সাদা কালোর এক সংঘাত থেকে যেন কবিতাটি নেমে এল crash landingএর মতো। “মৃত ডাচ সইনিক”এর উপস্থিতি একজন জাদুকরের মতোই এখানে।কিন্তু জাদুকরের উপস্থিতি তো আর জাদু নির্মাণের নিশ্চয়তা নয়। মৃত ডাচ সৈনিক কোন বৃষ্টিভেজা বিপজ্জনক পাহাড়ি রাস্তায় একটা আশ্বাসের ধাপ তৈরি করেছে শুধুআবহাওয়া তৈরি করেছে।তারপর অন্তর্হিত হয়ে আছে সেই ডাচ সৈনিক আর স্পষ্ট হচ্ছে অন্ধকারে জ্বলতে থাকা একা মোমের কান্না। আরেকটি কবিতা পড়ি এবার?

অনুপম- অবশ্যই। অশ্বঘোষ 'বুদ্ধচরিত'-এ লিখেছিলেন পিত্তরোগীদের কাছে শীত আরামদায়ক, তাই তারা শীতবস্ত্রকে ভোগ্যবস্তু ভাবে। কবিতার চিরকালীন শীত সুপর্ণা হোক।


অমিতাভ- “এই দেশে কোন ঘ্রাণ নেই কুয়াশার। পুরনো দরজা খুলে বেরিয়ে আসা জলবায়ু অতর্কিতে টেনে নিচ্ছে ভাঙা বলিরেখাদের। স্মৃতির অর্ধেক অংশে গেঁথে দেওয়া কাগুজে ভঙ্গিদেরআর পিছিয়ে যাওয়াকে এখন থেকে সময় বলছি আমরা সীমানা পেরিয়ে দেখছি তার ঘোলাটে চোখ কীভাবে অনন্ত হয়ে উঠছে নীল শবাচ্ছদের উপর তুলে রাখছে দুটো বিশ্বস্ত হাত। অথবা উজ্জ্বল আলোর নিচে বিব্রত এক মৃত্যু। যেখানে একটা রশ্মি হারিয়ে গেছে আমাদের শহরের ভেতর দিয়ে হারিয়ে গেছে কয়েকটা লাল রশ্মি, যা এই উপাখ্যানের গায়ে রেখে গিয়েছিল কোন অক্ষর ছাড়াই। এই কবিতা অনিন্দিতা ভৌমিক আমার মেয়ের থেকে সাতদিন আগে জন্মেছে বলে ওর সাথে এক স্নেহের বন্ধন আমি নিজের মধ্যে মেনে নি। কবিতাটির মধ্যে এক পরিতক্ত,অজানা,স্মৃতিরেখার সীমানায় বাঁধা ঝুরমুর করে ভেঙে পড়া কোনো অন্য পৃথিবীর কথা আছে।কবিতাটা পড়তে পড়তে লিওনারা ক্যারিংটন আর রেমেদিওস ভারো’র আঁকা কিছু predella-র কথা মনে পড়ছিল। predella প্রাক্ রেনেসাঁস যুগের একধরণের ছবি যা কিছুটা ধর্মমূলক; আধ্যাত্মিক। স্থির জীবনের কথা বলতে চায় বলে ছবিগুলিও যেন এক স্থির চিরন্তনতায় দাঁড়িয়ে। যেন একজন যাত্রী, যার শরীরের কোথাও কোনো যাত্রার লক্ষণ নেই- এক সন্ধানী যার মুখে অপার প্রসান্তি,কোনো দৃষ্টিতীক্ষ্ণতা নেই।– “তার ঘোলাটে চোখ কীভাবে অনন্ত হয়ে উঠছে নীল শবাচ্ছদের উপর তুলে রাখছে দুটো বিশ্বস্ত হাত। অথবা উজ্জ্বল আলোর নীচে বিব্রত এক মৃত্যু।" অনিন্দিতার এই দেখার সাথে কোথাও যেন Palatine predella বা রেমেদিওস ভারো’র Born again ছবির দেখা মিলে যায়। ছবি দুটো নিয়ে কথা বলার জায়গা এটা নয়। বলে কিছু বোঝানোও যাবে না হয়ত। একটা আবেগের জায়গা থেকে প্রসঙ্গটা এলো। ভালো কোনো অনুভুতি স্মৃতিকে ফেরায় তো!

Born Again. Remedios Varo

অনুপম - বাহ্! সত্যিই কিছু কবিতা শেয়ার করলেন। জয়শীলা একসময় 'বাক্‌'-এ লিখতেন। ওঁর কোনো বই আমার পড়া হয়নি। কিন্তু ওঁর কবিতা আমার সবসময়ই আকর্ষক লাগে। একটা নিজস্ব জগত আছে। পুরুষতান্ত্রিক ভাষাকাঠামোয় ওঁকে ঢুকতে দেখিনি। অনিন্দিতা ভৌমিকের লেখা খুব কম পড়েছি। যেটুকু পড়েছি ভাল লেগেছে। আপনার মুখে এই নামগুলো শুনে ভাল লাগল। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে আঘাত করলেন, এতেও আমি খুশ। দশক বলে কিছু হয় না। ওটা হীনমন্যতা থেকে উপচে আসা সময়ের মাপ। মিডিওকার কবিরা ওর মধ্যে ঢুকে নিজেদের সুরক্ষিত করতে চায়। আমি আজ নিজের দশককে পাত্তা-টাত্তা দিই না। কাজেই, মোগাম্বো বহুত খুশ হুয়া। কবিতার মধ্যে এখনও অনেক রহস্যময়তা অনেক আলোছায়া মনে হয় অপেক্ষা করে আপনার জন্য। একটা ব্যাপার দেখছি আপনি আলোচনাটাকে একদম সাম্প্রতিক কবিদের দিকে নিয়ে যেতে চাইছেন। তাদেরই বেছে নিচ্ছেন। এই যে নির্বাচন, এর মাপকাঠি কিছু আছে কোথাও। এভাবেই আজ থেকে দশ বছর আগে কারও কারও প্রতি আপনার অপরিসীম পক্ষপাত দেখা যেত। তখনও একটা ইয়ার্ডস্টিকের কথা মাথায় আসত। আর এখানে আমার কাজ আপনাকেই বেশি কথা বলিয়ে নেওয়া।

অমিতাভ- একদম না অনুপম! মাপকাঠি নেই।

অনুপম- এটাই শুনতে চাইছিলাম। বলিয়ে নিলাম।

অমিতাভ- হ্যাঁ, আসলে এখন হাতের কাছে এ মুহূর্তে এদের লেখাই ছড়িয়ে আছে। ব্যস! হ্যাঁ, একটা কারণ অবশ্য আছেই। তোমাদের প্রজন্মের যারা লিখতে এসেছে তারা অনেক আত্মস্থ, স্থির অভিমুখে তাদের যাওয়া, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে না কখনও। তোমাদের সময়ের লেখার ইনার ডিসিপ্লিন, টার্গেট ওরিয়েন্টেশন অনেক বেশি আর সামনে কোন মূর্তি রাখে না পুজো করার মতো।

অনুপম- আমার কোনো 'আমাদের সময়' তো নেইই অমিতাভদা। আমার সময় থেকে আমি নির্বাসন নিয়েছি। হা হা হা হা... আপনারই কথা সূত্রে বললাম। এবার আসি পরের প্রসঙ্গে। 

                                                              (ক্রমশ)

                                                    

2 comments:

  1. প্রতিটি পর্বই মনো্যোগ দিয়ে পড়ি। জানার পরিধি প্রসারিত হচ্ছে। খুলে যাচ্ছে নতুন পথ।

    ReplyDelete
  2. সজল দাসের প্রথম কবিতাটিতে 'কর্মে'র জায়গায় 'কমে' হবে।
    “কমে আসে যে ঘুড়ি তাকেই বেলুন বলি/ এমনিতে, একটা সময়ের পর/ দুজনেই উড়তে পারে না”।

    ReplyDelete