।। বাক্‌ ১২৪ ।। আমার বাবা ।। বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় ।।






আমার  বাবা


পত্রিকা প্রকাশের স্বপ্ন বাবাকে তাড়া করত সব সময়। যখন ভারতবর্ষ, বসুমতী এবং প্রবাসীতে নিয়মিত কবিতা বের হতে শুরু করে তখন থেকেই। পত্রিকা সম্পাদনা একজন কবির কবিতা লেখার ক্ষতি করে জেনেও বাবা এই কাজটির প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। এর পিছনে অনেকগুলি কারণ ছিল। কবিতার পাশাপাশি পত্রিকা নিয়েও বাবার একটি নিজস্ব ভাবনা ছিল। সাধারণত যারা নতুন কবিতা লিখতে আসেন  তাঁরা নিজেদের পরিচিতিকে আরও দীর্ঘ এবং বিস্তৃত করার উদ্দেশ্য নিয়ে একটি পত্রিকা করেন পরে অল্পবিস্তর নামডাক হয়ে গেলে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। বাবা এই মানসিকতার বিপরীতে হেঁটেছেন। 'কেতকী' প্রকাশের অনেক আগে থেকেই তার কবিতা বহু কাগজে প্রকাশিত হতে থাকে সেই সময় নচিকেতা ভরদ্বাজ এবং মোহিনীমোহন গাঙ্গুলী এই দুটি নাম যেকোন ম্যাগাজিনের  পাতা ওলটালেই পাঠকের চোখে পড়ত।এবং নাম দুটি অনেকের মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। পরিচিত মহলের সকলে  বিস্মিত হতেন এই ভেবে যে প্রত্যন্ত গ্রামে বসে কী করে একটি পত্রিকার সূচনা সংখ্যার খবরও পৌঁছে যায় তার কাছে। সুতরাং নিজেকে সম্প্রসারিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে তার সম্পাদকজীবনের অভিষেক হয় নি। 
       গ্রাম থেকে কাদামাটির দুর্গম পথ থেকে যে শব্দশিল্পী অনুসন্ধান করছে রাস্তা  তার পাশে এসে দাঁড়ানো। অন্ধকার কুয়োতলায় বসে যে নবীন কবি আত্মপ্রকাশের স্বপ্ন দেখছে তার কাঁধে হাত  রেখে তার যন্ত্রনাকে আত্মস্থ করা।
     পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে পত্রিকা প্রকাশ করা তখন খুব সহজ কাজ ছিল না। প্রেস নেই ধারে কাছে কোথাও। পয়সাও হাতে থাকে না। বেতনই আর কত। বাবা তখন আমবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সদ্য বদলি হয়ে এসেছে রামপুর নিম্নবুনিয়াদী বিদ্যালয়ে। বেতন মাসে ।সংসারে অনেক দায়দায়িত্ব।দাদু অবসর নিয়েছেন। পেনশন নেই( তখন শিক্ষকদের পেনশন ছিল না ) পত্রিকা প্রকাশের যন্ত্রণা বাবাকে  ক্রমাগত অস্থির করে তোলে। একটা দু ফর্মা ১/২ ডিমাই  পত্রিকা ৫০০ কপি ছাপা হবে। খরচের হিসেব শুনে বাবার মাথায় হাত। এত পয়সা  পত্রিকার পিছনে গেলে খাব কি ? এসব পত্রিকা টত্রিকা ছাপোষা মানুষের আয়ত্তের বাইরে। এসব ভাবলেও স্বপ্নটা  থেকে যায় মনের ভেতর। হঠাৎ একদিন  পুরুলিয়া শহরে  প্রবীন কবি ও সাংবাদিক সুনীতিকুমার  পাঠকের সাথে দেখা হয় বাবার। কুশল জিজ্ঞাসা এবং অন্যন্য গল্পের পর বাবা জিজ্ঞেস করেন – সেরকম কোন প্রেস জানাশোনা আছে আপনার? একটা পত্রিকা করার কথা ভাবছিলাম।
     -এ তো খুব ভালো কথা মোহিনী। আমার নিজেরই  একটা প্রেস আছেতোমার কোন চিন্তা নেই। বাবার পিঠে হাত রেখে সুনীতিকুমার পাঠক কথাগুলো বললেন। 
       বাবার তবু চিন্তা যায়না – দেখুন  পত্রিকার জন্য খুব বেশি খরচ করার সামর্থ্য আমার নেই । 
      -ও নিয়ে ভাবছ কেন ?  চলই না আমাদের প্রেস দেখে আসবে , কাজ দেখে আসবে । তারপর পছন্দ হলে পত্রিকা করবে।
     বাবাকে সুনীতি প্রেসে নিয়ে গিয়ে তাঁর ভাই অরূপ পাঠক এবং বিশ্বরূপ পাঠকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন সুনীতিবাবু -  তোরা, একে চিনিস মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায় নাম শুনে থাকবিপ্রচুর লেখালেখি করেএকটা পত্রিকা করতে চায়। কাজটা ভালোভাবে করে দিস।
      সুনীতি প্রেসের মালিক অরূপকুমার পাঠকই কবিদের ছোট কাগজ কেতকী প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেদিন। নামমাত্র ছাপা খরচা নিয়ে তিনি কাজটি করেছিলেন। ১৯৬৯ সালের এক গ্রীষ্মের দুপুরে  কেতকীর প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা  প্রকাশিত হয়। প্রথম সংখ্যায় লেখার জন্য আবেদন জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য, শুদ্ধস্বত্ত্ব বসু, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, নচিকেতা ভরদ্বাজ প্রমুখ কবিদের। তাঁরা সানন্দে কবিতা পাঠিয়েছিলেনপত্রিকার প্রচ্ছদ এঁকে তার ব্লক করে পাঠিয়েছিলেন কবি শিল্পী  বিষ্ণু সামন্ত। কেতকীর প্রথমদিন থেকে  পরপর অনেকগুলি সংখ্যার প্রচ্ছদ তিনি করেছেন। বাবার অনেক বইয়ের প্রচ্ছদে রয়েছে তাঁর নিপুন তুলির ছোঁয়া।
      ছয়ের দশকে সামাজিক জীবন যখন আলোড়িত একদিকে খাদ্য আন্দোলনের অনিবার্য পটভূমি খিদের তাড়নায় মানুষ যখন অস্থির দিশাহারা জীবিকার সন্ধানে একবাটি ফ্যানভাতের স্বপ্ন নিয়ে  বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সামিল হচ্ছে আপামর সমস্ত মানুষজন স্ট্রাগল ফর একজিস্টেন্স অস্তিত্ব রক্ষার সেই সংগ্রাম শুধুমাত্র জৈবিক ক্ষুধা নিরসনের নিরন্তর প্রয়াস নয় সাংস্কৃতিক ক্ষুধাও অনুভূত হয়েছিল সেদিন চিন্তাশীল মানুষরা বুঝেছিলেন এই সংকট আসলে কৃত্রিম এবং প্রণোদিত মানুষের কাছে এই বার্তাকে পৌঁছে দেওয়ার এবং সমস্যা সমাধানের সঠিক দিশা নির্নয়ের দায়ভার কবি শিল্পী এবং চিন্তনশীল মানুষের  শুধু কলকাতাকেন্দ্রিক ভাবনা নয়, সেই বৃত্ত  থেকে সম্পূর্ণ সরে  এসে  সুস্থ এবং পরিশুদ্ধ  সাংস্কৃতিক বিকেন্দ্রীকরণ সেদিন জরুরি হয়ে উঠেছিল এই প্রেক্ষাপটের উপর দাঁড়িয়ে নতুন নতুন চেহারা নিয়ে অবয়ব নিয়ে বিভিন্ন জেলায় জন্ম নিচ্ছিল কিছু কিছু ছোট কাগজ এক আবেগ এবং উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে শুরু হলেও তা আসলে একটি আন্দোলনের চরিত্র নিচ্ছিলতামাম পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ইতিবাচক সাংস্কৃতিক শৃঙ্খল সুগ্রন্থিত হচ্ছিল বাণিজ্যিক ট্রেডমার্ক চিহ্নিত পত্রিকাগুলিই সাহিত্যের নিয়ামক বা নিয়ন্ত্রক নয় বরং তারা আগ্রাসী পুঁজির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং নিজেদের কায়েমী  স্বার্থে মানবমুখীন সাহিত্যের বিকশিত ধারাকে  বিধ্বস্ত করতে চায় লিটল ম্যাগাজিন তাই সেদিন এক সমান্তরাল সাহিত্যের জন্ম দিয়েছিল ক্রমিক অভিযানের ভেতর দিয়ে নিরন্তর লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যা আজ  সাহিত্যের মূলস্রোতে পরিণত
      'কেতকী'? কেন এই নামকরণ ? এই প্রশ্ন বারবার আমাকেও তাড়া করে  কেতকী বর্ষার ফুল গ্রামভিত্তিক বাংলার মূল অর্থনীতি কৃষি যা বর্ষা নিয়ন্ত্রিতএকদিকে প্রাণ উদ্দীপনা  সমস্ত মলিনতা মুছে ফেলার আয়োজন এবং ক্ষুধা নিবৃত্তির ঋতুচিত্র অন্যদিকে  গ্রামীণ সৌন্দর্যের প্রকাশ এই  প্রতীকায়নের ভেতর দিয়ে ফুটে উঠেছে তার বক্তব্যের উজ্জ্বলতা  প্রান্তিক অবস্থান থেকে এক মুক্তচিন্তার আবহ গড়ে তুলে  বিকশিত ভাবনাকে সুদূরপ্রসারী করে তোলা তার ঘোষিত নীতিই হচ্ছেসত্যিকারের কবির গলায় কোন বকলস নেই সে স্বাধীন মুক্ত সর্বত্রগামী কাদাপথের দুর্গম মানচিত্রে বিকশিত ফুলগুলির আত্মপ্রকাশের সুযোগ, বৃহত্তর পাঠক গোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি জীবনমুখী ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করা
    ছয়ের দশকে অনেকগুলি ম্যানিফেস্টো-ভিত্তিক আন্দোলন বাংলা কবিতাকে আলোড়িত করেছিল। হাংরি, শ্রুতি, থার্ড লিটারেচার, ধ্বংসকালীন,  নিম আন্দোলনএই আন্দোলনগুলির সাফল্য বা ব্যর্থতা ইতিহাস মূল্যায়ন করবে। কেতকী এইসব কোন আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত থাকেনি কিন্তু প্রত্যেকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেছে। কবিতায় নতুন ভাবনার অনুপ্রবেশকে সে স্বাগত জানিয়েছে অভিনন্দিত করেছে। অথচ কবিতার নির্দিষ্ট কোন মানচিত্রে সে বিশ্বাস করে নি। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে পুরুলিয়া জেলার সাহিত্যের প্রানকেন্দ্র ছিল আদ্রা এ কথা আগে বলেছি। সেদিন আদ্রাকে কেন্দ্র করেই উঠেছিল সাহিত্যের এক উজ্জ্বল বাতাবরণ যা সমগ্র জেলাকে দিশা দেখিয়েছিলপ্রচুর গুনীজনের সমাবেশ ঘটেছিল ছোট্ট রেল শহরে তখন সারা জেলায় যে কয়েকটি কাগজ ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে দায়বদ্ধতা পালন করেছিল, এদের মধ্যে শঙ্খ এবং কৃষ্ণচুড়ার কথা বিশেষভাবে বলতে হয়।অধ্যাপক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায় রঘুনাথপুর কলেজে যোগদানের পরই পত্রিকা প্রকাশনার ক্ষেত্রে এবং বৈঠকী সাহিত্যের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছিল।   
       ১৯৬৯ সালের এক গ্রীষ্মের বিকেলে কেতকীর জন্ম অনেকে আনন্দিত হলেন বললেন এরকম একটি কবিতাপত্রের প্রয়োজন ছিল এই জেলায় অনেকে বিস্মিত হলেনঅনেকে সংশয়াচ্ছন্ন এই পত্রিকা চলবে তো না কি মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যাবে তার প্রবাহ অনেক জিজ্ঞাসা অনেক কৌতূহলের ভেতর দিয়ে কেতকী হয়ে উঠল সাহিত্যপ্রেমী মানুষের ভালোবাসার সম্পদ মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায় এরকমই এক ব্যক্তিত্ব যিনি সবাইকে সাথে নিয়ে রাস্তা হাঁটতে ভালোবাসেন তাই উচ্চপদস্থ আমলা থেকে আরম্ভ করে স্কুলের প্রধান শিক্ষক রাজনৈতিক কর্মী, আইনজীবি কেরানী শ্রমিক এবং বেকার যুবক যুবতী সকলকেই নিয়ে এলেন এক ছাতার তলায়
       কেতকীর প্রথম সংখ্যা প্রকাশের পর  দেশ, আনন্দবাজার, যুগান্তর এবং সাপ্তাহিক বসুমতী পত্রিকায় আলোচনা বের হল। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর সম্পাদিত ‘বাংলা কবিতা সাপ্তাহিক’-এ লিখলেন – যে গ্রামে একটি পোস্ট অফিস পর্যন্ত নেই  সেই শিয়ালডাঙ্গা  গ্রাম থেকে চার ফর্মার একটি কাগজ প্রকাশিত হচ্ছে যা কবিতা দিয়ে ভর্তি, তার নাম কেতকী”এরপর অনেকেই কেতকীর গ্রাহক হওয়ার জন্য  আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগল। প্রচুর চিঠি আসতে শুরু করল কেতকীর দপ্তরে । কেতকীর সার্কুলেশন বাড়তে লাগল। সেদিন কেতকীর উপদেষ্টা মণ্ডলীতে ছিলেন কবি  নচিকেতা ভরদ্বাজ যেকোন লিটল ম্যাগাজিনের পাতা খুললে যার নাম কবিতা প্রথমে মুদ্রিত হত, যষ্টিমধু পত্রিকার সম্পাদক  কুমারেশ ঘোষ, পূর্ণেন্দুপ্রসাদ ভট্টাচার্য, সম্পাদক সারা বাংলা সাহিত্যমেলা, মদনমোহন বেরা, অধ্যাপক দিলীপ বসু, হরিপদ কুণ্ডু, ডঃ ব্রজদুলাল চক্রবর্তী, কবি নিমাই মান্না, যতীন্দ্রনাথ মান্না, অনুপম মিত্র, তারাপদ ধর (তখনও ঈশ্বর ত্রিপাঠী নামে পরিচিত হননি), নয়নকুমার রায়, অনুপম মিত্র, সুদর্শন রায়সম্পাদক মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, সহ সম্পাদক- বিষ্ণুপদ সামন্ত, চিত্ত দাশ এবং শুভাশিস ত্রিপাঠী। প্রথম সংখ্যার মূল্য ছিল এক টাকা মাত্র।
      প্রথম সংখ্যাতেই লিখেছিলেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল খ্যাতিমান সাহিত্যিকবৃন্দ ওই বছরই শারদ সংখ্যার সূচিপত্রে যে নামগুলি মুদ্রিত আছে তারা হলেন  প্রেমেন্দ্র মিত্র, আনন্দ বাগচী, সুধীর করণ, কুমারেশ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ মিত্র, গোপাল ভৌমিক, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, বিনোদ বেরা, বেণু গঙ্গোপাধ্যায়, আলোক সরকার, রত্নেশ্বর হাজরা, ব্রজদুলাল চক্রবর্তী, নচিকেতা ভরদ্বাজ, তারাপদ ধর, কালীপদ কোঙার, কামাখ্যা সরকার, অসীমকৃষ্ণ দত্ত, বিমলকান্তি ভট্টাচার্য, মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, পূর্ণেন্দুপ্রসাদ ভট্টাচার্য, অরূপকুমার পাঠক প্রমুখ। 

      তখন তো আজকের মতো ফটোশপ ছিল না। ডিজিটাল বিশ্বের নান্দনিক হাতছানি ছিল না। তখন একটি পত্রিকার প্রচ্ছদ বানানো ছিল তীব্র আত্মনিবেদনের সুসংহত পরিশ্রমের। কেতকীর সেই প্রাকলগ্নে কবি এবং চিত্রশিল্পী বিষ্ণুপদ সামন্তের ( সেই সময় তিনি বিষ্ণুপদ সামন্ত নামেই পরিচিত ছিলেন , এখন বিষ্ণু সামন্ত )   নিরলস এবং নিবিড় সংযোগ কেতকীকে মনোগ্রাহী করে তুলেছিল।তাঁর অজস্র ছবি, তুলির টান নিবেদিত শ্রম কেতকীর যাত্রাপথে সঙ্গী হয়ে আছে। আমার কাকু ফনীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন একজন সত্যিকারের নিবেদিত শিল্পী। ছবি আঁকা এবং নাটকের জন্য তিনি নিজের চাকরি পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছিলেন।অথচ পেশাদার শিল্পী হয়ে ওঠবার কোন অভিপ্রায় তাঁর ছিল না। নিছক ভালোবাসার টানেই তিনি লিপ্ত ছিলেন এই দুই শিল্প মাধ্যমের সাথে। নাম যশ বা আর্থিক প্রাপ্তির কোন অঙ্ক তার ভাবনার পরিসীমানায় স্থান পায়নি। কেতকীর জন্য অনেক প্রচ্ছদ এবং লেটারিং এর কাজ তিনি করেছেন। পাশাপাশি তাঁর সুন্দর সুন্দর অলংকরণ  কেতকীর পাতাগুলি ঋদ্ধ ও সুবাসিত করেছে। তাঁর মৃত্যু কেতকী পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি।
      কেতকীর প্রচ্ছদ শিল্পীর তালিকা দীর্ঘ। সকলের নাম এই মুহূর্তে আমার মনে নেই।তবু সেই নামগুলিকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করতেই হবে নইলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না। শ্রদ্ধেয় শিল্পী  পূর্ণেন্দু পত্রীর প্রচ্ছদ এবং নামাঙ্কন কেতকীকে সমৃদ্ধ করেছিল। চারু খান এর অনন্য প্রচ্ছদ  অনবদ্য উদাহরণ হয়ে আছে। পান্নালাল মল্লিকের নামাঙ্কন ও প্রচ্ছদ এক স্বতন্ত্র ধারার জন্ম দিয়েছিল। সুধাংশু বাগের বিমূর্ত ছবিগুলি কেতকীকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছিল। নন্দদুলাল রায়চৌধুরী, ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ মুকুল, দিগম্বর দাশগুপ্ত, অরূপ কর্মকার, লালমোহন কুম্ভকার, অনাদি বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল ভট্টাচার্য, অজিত রায়,  মধুছন্দা মিত্র ঘোষ, ধীমান পাল, অনির্বাণ পাল, দয়াময় বন্দ্যোপাধ্যায়, মেঘ অদিতি থেকে আরম্ভ করে চিনের হুয়ান শিয়ান পো এর শিল্পভাবনা আবিষ্ট করেছে কেতকীর পাঠকদের।সাম্প্রতিক কালের এই শিল্পীদের কথা পরে সবিস্তারে কোন এক সময় বলা হবে। ছোট কাগজ সম্পর্কে বাবার যে দৃষ্টিভঙ্গি যে অভিমুখ তা লিপিবদ্ধ হয়ে আছে একটি কবিতায় তা হুবহু তুলে ধরলাম-  
আমাদের লিটল ম্যাগাজিন আছে,
আছে স্বপ্নে ভেজা  গোলাপি সকালের স্নিগ্ধতা
আমরা আনন্দ চ্যাটার্জি  লেনে অথবা প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের
অহংকারী বাড়িগুলোর দিকে তাকাই না
আমাদের ছেঁড়া পাঞ্জাবি আর ফুটিফাটা  পাতলুন
ছোট সংসারের গল্প শোনায়
মধ্যবিত্ত বিছানায় ঝড় উঠলে পকেট হাতড়ে  বের করি
ভাঙা সিগারেট আধপোড়া বিড়ি
পুরু লেন্সের  চশমায় আমাদের চোখগুলো ধারালো হয়ে যায়
কাধের ঝোলা থেকে লাফিয়ে পড়ে দেশি ডটপেন
নিউজপ্রিন্টের লেটারপ্যাড দুফর্মার কটা জার্নাল
আমাদের উল্লাস পুঁইমাচায় ফুল ফোটায়
জোয়ারি রুটির আস্বাদ আনে

আমাদের খিদে বিশাল ময়দানের দিকে এগিয়ে যায়
জানালা খুলে উঁকি দিয়ে যায় কটা  চেরি ফুল আর গন্ধরাজ
বোবা নদী এখন সঙ্গীতে  মুখর সমুদ্র সঙ্গমে  ঢেউয়ের হাত বাড়ায়
অস্ফুট মুকুল এখন পরিপূর্ণতার উল্লাসে সোচ্চার
বসন্তবিকাশের গান শোনায়
অনড় পাথর কেঁপে ওঠে, শব্দ তুলে তুলে শর্তহীন মর্মরে
বিজ্ঞাপন সাঁটে
অনির্বাণ সংস্কৃতি পুরানো খোলস ছিঁড়ে
মহাজনী হিম বাতাসে নখের আঁচড়ে দাগ কাটে
বণিকের হাত থেকে খসে যায় অর্জিত দলিল
পাটোয়ারী অধিকার ও লোভের আখ্যানমঞ্জরী
কফিহাউসের দেমাকি মেজাজের উপরে  চাবুকের ঘা পড়ে
থেমে যায় অহংকারী আওয়াজ
আমাদের লিটল ম্যাগাজিন আছে, আছে
স্বপ্নে বোনা দু বিঘে জমি
এ নিয়েই আমাদের মুঠো ভর্তি শস্যবীজ সর্বাঙ্গসুন্দর শিলান্যাস
আমাদের ম্যাপলিথো কাগজ হাফটোন ব্লকের  স্পর্ধা
কিংবা অফসেটের অহংকার নেই
সস্তার নিউজপ্রিন্টে আছেপাইকার শিল্পিত ভালোবাসা
অশ্রুভেজা চোখ ও কান্নাগুলোকে  টেনে নিয়ে যাই
রক্ত ও বারুদ মাখা কম্বোডিয়া রডেশিয়ার দিকে
আমাদের চোখে চেরি ফুলের স্বপ্নে শিশির ভেজা সকাল আসে
মধ্যাহ্নে জোয়ারি রুটি পুঁই চচ্চড়ির আস্বাদে সবুজ শর্করা
ও ভিটামিন স্বাস্থ্যনিবাসের ঠিকানা জানায়
জমাটি আড্ডায় তেজী কবির রাগী মুখ
পত্রিকার প্রচ্ছদ হয়ে যায়
সেক্সি যুবতির গালে চড় বসিয়ে
অনেকগুলো  শক্ত হাত স্তব্ধ  করে দেয় মৃতবৎসা  কবিদের
ডন কুস্তি বৈঠকের মহড়া

আমাদের লিটল ম্যাগাজিন আছে  আছে বারুদশালা
                                                                                           (ক্রমশ)




No comments:

Post a Comment