।। বাক্‌ ১২৪ ।। মণিদীপা সেন ।।




মফস্বলীয় নব্বই- নন মেকানিক্যাল এরা বিনিথ দ্য স্কিন অব টাইম

জায়গাটা ওই গ্রাম থেকে আধা শহর। পাট চোকানো জমিদারবাড়ি একটা জার্মান শেফার্ড পুষেছে। গেটওয়ালা বাগানবাড়িগুলোর বনেদী ভিত খুঁড়লে আজও উঠে আসে ভাঙা নৌকোর জ্যা। বলে নাকি এ চত্ত্বর এককালে গঙ্গার চারণভূমি ছিল। তারপর জল সরে যায়- বসত আসে। গলি- তস্য গলির ভেতর এখনও কার্নিসের মত মুখ বের করে থাকে লাল মেঝের বাঁধানো রক- ফাঁকা- ধূলো পড়া। পুকুরের শানপাড়গুলোর ইট বেরিয়ে গেছে- গোণা যায় পাশ ফিরে শুয়ে থাকা পুরোনো সময়ের পাঁজর। এখনও নতুন পিচের রাস্তাকে লাল ফলে ঢেকে দিতে কসুর করেনা বয়োবৃদ্ধ বট। কালো বুক জুড়ে ছড়িয়ে থাকে মৃত গ্রামের অ্যালভিওলাই। সদ্য ধনীর স্করপিও থেঁতলে দিয়ে যায় পাখির খাবার।
বাচ্ছাগুলো বাড়ির কাছের ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ড ছেড়ে অধিকাংশই হলুদ বাসের সিবিএসই /আইসিএসই। ছুটির সময় ওরা হুড়মুড় করে ছোটে না- সুশৃঙ্খল শ্লথগতির নিয়ন্ত্রক আসলে পিঠের ওজন। মাস্টারবাড়ির করবী গাছটা এসব দেখে একটা করে ফুল ঝড়িয়ে দেয় পাশের পুকুরে। জলের চাদরে ইতিউতি ভাসতে থাকে সাদা পাপড়ির গাছের ফোঁটা, যার কেন্দ্রে থিতিয়ে গেছে হলুদ রঙ। সাঁতারু বিকেলে কোনো বাচ্ছা আসেনা তাদের সন্ধ্যের মুখে জড়ো করতে। এখন সবই স্কুলের এক্সট্রা ক্যারিক্যুলাম- দেড়লাখি নীল জল আর চাপ চাপ সুইমিং কস্টিউম!
পাড়া ছেড়ে চলে গেছে জনপ্রিয়, সংবেদনশীল পুটু পাগলি। অরুণদের বাড়ির উল্টোদিকের রকে তার সাদা খরগোশ দুটো সবুজ ঘাস মুখে নিয়ে বসে থাকত আর পুটু তার আলুথালু জড়ানো ফেডেড গেরুয়া শাড়ির আঁচল সরিয়ে স্তনের বোঁটা খুঁটত আপনমনে। সেই বৃন্তের চারপাশে নীল নীল শিরা চারিয়ে গেছে –নেমে গেছে পুটুর শরীরে। সব মিলিয়ে সে এক গভীর ভারতবর্ষ! বাড়ির পাশের মিষ্টির দোকানে এসে একবার বলেছিল, “ পয়সা দিলাম তাতেও খারাপ দইটা দিলি? কি ভাবিস? পাগলি? পাগলির পেট ভালো- খারাপ বোঝে না?” কাউন্টারের ছেলেটা কেমন চোকড হেসে কাটিয়ে দিতে চেয়েছিল। বলেছিল, “আচ্ছা, আর এক ভাঁড় নিয়ে যাও”। ততক্ষণে পুটু মোড়ের মাথায়, আধখোলা ফেডেড গেরুয়া শুষে নিচ্ছে রাস্তার ধূলো। যেন অসতের মুখে থাপ্পর মেরে ঘেন্নায় অপসৃয়মান ভারতমাতা।
লম্বা লতানো ডাঁটি লাল পাপড়ি পাঁচটা। ঠিক মাঝে একটা ছিদ্র। এক ফুলের প্রান্ত অন্য ফুলের বুকে ঢুকিয়ে সূচ ছাড়াই আস্ত মালা গাঁথা যেত। সেসবে পুতুলের বিয়ে হত। পাথরকুচির পাতা টুকরো করে ভোজ। লুচিপাতার অভাব ছিল না মাঠের ধারে। বিকেলে মাঠ ভর্তি থাকত উভলিঙ্গে। ভয় ছিল না তখন। সিনিয়র ছেলেটা খিঁচিয়ে উঠে ক্রিকেট ব্যাট কেড়ে নিয়ে মেয়েটাকে বলেছিল, “উঁউঃ! ক্রিকেট খেলবে। জানিস কিছু ক্রিকেটের?” বাচ্ছা মেয়েটাও মুখ ঝামটে উত্তর দিয়েছিল, “জানি- সব জানি”। “বলত এক ওভারে কটা বল থাকে?” মেয়েটার সপাট উত্তর, “ছ’টা”। ছেলেটা দাঁত কিড়মিড় করে ব্যাট ফিরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলেছিল- রিপান, বল কর একে! হ্যাঁ তখনকার সময়ে কথায় কথায় নাবালিকা ধর্ষন হত না- নাবালকদের প্রোগ্রামিংটা খানিক অন্য ধাঁচের ছিল।
শীর্ষেন্দুর কিশোর উপন্যাসের চরিত্ররা এক্সিস্ট করত। পাড়ায় পাড়ায় খ্যানখ্যানে ডিজে-র বদলে স্টেজ বেঁধে জলসা হত। মা- কাকিমারা দুপুরে খাওয়ার পর মুখে পান গুঁজে দুর্বোধ্য ভাষায় পিএনপিসি করত। কিটি পার্টির বিচিং এর চেয়ে সেটা অনেক নির্মল ও নিরাপদ। শীতের ছাদে রোদ বিনিময় হত। কাঁচ গুঁড়ো মাঞ্জা টানতে এক মোড়ের লাইটপোস্ট থেকে অন্য পোস্টে সুতো বাঁধার সময়ে প্রত্যেক পাড়ার রক্তের গোত্র এক হয়ে যেত।
তবে এখনও বিশু মাতাল নর্দমার ধার থেকে কলকে ফুল কুড়িয়ে চার মাথার মোড়ে রক্ষাকালীর থানের ওপর পা ফাঁক করে দাঁড়ায়। তারপর সযত্নে সাজিয়ে দেয় বাবাছাপ ফুল মায়ের পায়ে। এক এক করে।
ক্যারমবোর্ডের ওপর নেমে আসে পরিবর্তিত আলোকবৃত্ত। আমি দেখতে পাই প্রত্যেকটা নব্বই দশকের সন্তান সময়ের সরলরেখার এদিক ওদিক পা রেখে এরকমই বিচিত্র ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। যার এক পায়ে হব্যিষ্যান্নের মত সহজপাচ্য শৈশব- কৈশোর অন্য পায়ে অত্যাধুনিক যৌবন ও একলা বার্ধক্য। আর মাঝে আঠাশ দিনের শেষের নষ্ট ডিম্বাণুর মত ছড়িয়ে আছে একটা অতীতবিধুর নিষ্পাপ সমুদ্র, প্রাচীন কিছু মূল্যবোধ- একটা আস্ত সভ্যতা।



3 comments:

  1. অসাধারণ। কুর্নিশ জানাই।

    ReplyDelete
  2. এই লেখাটি বিশেষ গদ্য বিভাগে থাকলে হয়ত বেশি ভাল হ'ত। (ব্যক্তিগত মনে হওয়া)।
    একটা আচ্ছন্ন করে দেওয়া পরিবেশ তৈরী করে, সবটা পড়ার পর।

    ReplyDelete