অতীত, মানুষকে সারাজীবন ছুঁয়ে থাকে, লেহন করতে থাকে তার
বর্তমানকে। অ্যালঝাইমা অথবা বিস্মৃতি একটি রোগমাত্র।তা ছাড়া এমন কোন মানুষ নেই
বোধয় যিনি স্মৃতি আক্রান্ত হন না। আর সেই নিজস্ব স্মৃতির ভেতর কতযে
ভ্রান্ত-অভ্রান্ত মতামত, কত নষ্ট ও অনষ্টালজিয়া,কত ভালো করেছি না খারাপ করেছি,কৃতজ্ঞতা ও কৃতঘ্নতা,
প্রতারিত হয়েছি না প্রতারণা করেছি,
এইসব নিয়ে তর্কণ ও চর্বণ চলতে থাকে নিয়ত। যখন কাজের মধ্যে
থেকেছি/থাকছি তখন স্মৃতিবিলাসের দরকার পড়ে নি। আমি মানুষটা একটু স্মৃতিবিলাসী বটে।
কখন ঘি খেয়েছিলুম এখনো হাতশুঁকে তার গন্ধ নিই, নিচ্ছি।
জীবনের
যে পর্ব নিয়ে এই পাঁয়তারা, সেটা কারো কাছে
হিরোগিরি হতে পারে, আমার কাছে কুড়িবছর আগে তো ছিলই, এখনো সেই হিরো হবার সাধ যে নেই তা বলি কী করে? কুড়ি
বছরের কোন্ যুবা না চায়, লোকে তাকে হিরো বলুক! সমীহভরা চোখে
তার দিকে তাকিয়ে থাকুক। আমি তো তখন তাই চেয়েছিলাম। চে গ্যেভারা হতে, মাও সে তুং হতে, সূর্য সেন হতে। রাইফেল হাতে দেশের
সব চেয়ে পিছিয়ে পড়া ঝাপসামানুষটির পাশে দাঁড়ালে সেও একদিন আলোময় হয়ে উঠবে।এই ছিল
স্বপ্ন।
সব
স্বপ্নই ঘুম ভাঙলে অবাস্তব মনে হয়, কিন্তু
তার রেশ থেকে যায়। স্বপ্ন দেখা চলতেই থাকে, মানুষের সঙ্গে
সঙ্গে স্বপ্নও তাই চলতে থাকে।পৃথিবীতে যতদিন মানুষ থাকবে, স্বপ্নও
থেকে যাবে।
আজ
পিছনের দিকে তাকালে চমৎকৃত হই! এমন অনেককিছু আছে প্রথম যৌবনের রসায়ণে লুকিয়ে, যা করেছি একদিন আজ তা
অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে যায় হয়তো।
ওড়িশার
ময়ুরভঞ্জ জেলার বাংরিপোসি, সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট এর একটা
প্রান্তে অবস্থিত। এখান থেকে এরিয়াল ডিস্টেন্সে ঝাড়খন্ডের চাইবাসার হেসাডির দূরত্ব
প্রায় ৮০ কিমি। সিমলিপালের কোর এরিয়ায় চহ্বালা বা জোরান্ডার দূরত্ব ১০০কিমিএর
কাছাকাছি।
১৯৯৭-৯৮এ
বাংরিপোসির ঘাটি পেরিয়ে কয়েকটি সরকারি বাস ছাড়া পাবলিক যান ছিলই না। মালবাহি ট্রাক
ধরে হিচ্ হাইক করে বাংরিপোসি ঘাটে নেমে আমরা হাঁটা দিতাম.... প্রথম ৩০ কিমি
গহনপাহাড় জঙ্গলের রাস্তায় তারানাগাঁওয়ের দিকে। এ রাস্তায় কোনো সভ্যমানুষের চিহ্ন
দেখিনি কোনোদিন। ছোট ছোট হো বা মুন্ডারি আদিবাসীদের গ্রাম। আমরা অবশ্য রাস্তা তৈরি
করেই চলতাম। গহন হরজাই জঙ্গলের ভিতর দূর্গম পাহাড়গ্রামে কে আর রাস্তা বানাতে
যাবে।সাঁওতালি ভাষাটা মোটামুটি জানা ছিল বলে দলের মধ্যে আমার কদর ছিল বেশি। সঙ্গে
স্থানীয় দু একজন থাকতো আমাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে। প্রথমদিকে এক একটা গ্রামে এক এক
রাত্রিযাপন ছিল আমারকাছে, দূর দারুচিনি দ্বীপে প্রেমিকার সাথে প্রথম
সঙ্গমের মতো পুলকবহুল।
বনেপাহাড়ে আমার
সেই প্রথম পা রাখা।
বাংরিপোসি
ঘাটিতে তখন যাবার উপায় বলতে পাবলিক যান কিছু ছিল না।একটা সরকারি বাস সকালের দিকে
বারিপদা থেকে বম্বেচক হয়ে বাংরিঘাটি পেরিয়ে চলে যেত রৌরকেলার দিকে।কিন্তু সে বাস
বাংরিপোসি বা বিষোই তে দাঁড়াতো না।ফলে বম্বেচক থেকে লরি বা ছোট ট্রাকের হুডে চেপে
হিচ-হাইক করে নেমে পড়তাম ঘাটির উপরে।বাংরিঘাটির রাস্তা নয়ের দশকে ছিল ডাইনোসরের পিঠের
মত সেখানে দুয়ারসিনি মন্দিরের চাতালে আমাদের জন্য অপেক্ষা করত কানু মুন্ডা বা
বীরসিং ওরাঁও।কানু থাকলে যেতে হবে তারানা'য়। বীরসিং নিয়ে যেত
রঘুগোড়ায়। এখান থেকে লাগভাগ ১৮ কিমি।
পাহাড়-জঙ্গলের
এই রাস্তাকে রাস্তা না বলাই ভালো। প্রমদারঞ্জন রায়ের বনের খবর যাদের পড়া আছে এপথের
বর্ণনা তারা আন্দাজ করতে পারবেন।
হাতিচলা
পথ। কোথাও আবার পথবলে কিছুই নেই। ফুলপ্যান্ট আর ফুলহাতা জামা না থাকলে কাঁটায়
চামড়া ছিড়ে রক্ত পড়তে থাকে। বর্ষাকালে মাটিতে গাছে পাতায় জোঁক। আধঘন্টা হাঁটার পরই
জামা খুলে দেখে নিতে হয় কটা জোঁক ধরেছে। আমরা কাঠির ডগায় নুনের পুটলি বেঁধে
রাখতাম। জলে ডোবানো নুনের পুঁটলি দিয়ে জোঁক ছাড়ানো হত।
এরাস্তায়
অভ্যস্ত মানুষও একঘন্টা হেঁটে দু কিমির বেশি যেতে পারে না। কোথাও উত্তুঙ্গ পাহাড়
বেয়ে খাড়াই উঠে গেছে,তারপরই দু তিন শো ফুট
খাদের নিচে কাঁটাঝোপ ও হরজাই গাছের জটলার মধ্যে হারিয়ে গেছে।
রাস্তায়
ছিল মারাত্মক কিং কোবরা (শঙ্খচূড়)র ভয়। শ্যাওলাধরা গাছের সরু ডালের মত রঙ।কোনোটা
আবার শুকনো কচিশালগাছের মত।রাস্তা পেরোলে বোঝাও যেত না।তবে মানুষের থেকে অনেক দূরে
থাকতেই ভালোবাসে ওরা।কিন্তু আমরা যে পথ বেছে নিতাম সে পথ যে ওদের ঘরের উঠোন দিয়েই
গেছে।
রাস্তায়
ভয় ছিল আর এক হারামজাদা পশুর। ভালুক। বুকে সাদা রঙে V লেখা থাকত, যেন এদের সৃজক, প্রজাতিটি
যাতে লোকে চিনতে পারে তাই দাগ দিয়ে রেখেছে! চলার সময় সাবধান না থাকলে বলাকওয়া না
করে ঘাড়ে এসে পড়বে। তারানার পাঁচ ছয় জনকে দেখেছিলাম যাদের নাক বা কান নেই। কারো
পিঠে নখের গভীর গর্ত।এসবই তেনাদের কীর্তি। অবশ্য ভালুক ভয় না পেলে এবং তার খাবারে
ভাগ না বসালে তাঁরা কিছু করেন না।ভালুকের আক্রমণ বেশী হয় বসন্তে মহুলফুলের সময়। মানুষে
মহুলফুল কুড়োতে যায় আর তারাও মহুয়ার সন্ধানে বেরিয়ে গাছতলায় প্রতিপক্ষকে দেখে
বিরক্ত হয় আর অপেক্ষাকৃত দুর্বল মানুষের নাক কান ছেঁড়া যায়।
কিন্তু
একটা অদ্ভুত ব্যাপার, এতদিন ধরে শহরের
ক্যাডার বা গ্রামের অনেক ছেলেমেয়েই তো জঙ্গলে কাটিয়েছে,কাটাচ্ছে অনেকেই।
কিন্তু আজপর্যন্ত কোনো সদস্যকে সাপে কামড়েছে বা বুনোপশু মেরে ফেলেছে এমন খবর আমার
কাছে অন্ততঃ নেই। তখনো ছিলনা....
পরের পর্ব কবে পড়র
ReplyDeleteপরের পর্ব কবে পড়ব
ReplyDeleteবেশ
ReplyDeleteখুশি হলাম দুর্বার লেখা পড়তে পেয়ে।
ReplyDelete